এমা নীপার কথা চিন্তা করে। নীপা আর ফনির সর্ম্পক নিয়ে ভাবে। কী করে সম্ভব সব কিছু বলে দেওয়া। এমা অবাক হচ্ছে তার সর্ম্পকেও নীপার প্রেমিক একটা কথা বলেছে সেটাও সত্যি। অথচ এ কথা নীপা ছাড়া অন্য কেউ জানে না। নীপা ফনিকে এ কথা বলেনি। অথচ ফনি সেদিন বলে দিয়েছে তার প্রেমিকের কথা।
নীপার সাথে এমার যখন পরিচয় হয় তারা কলেজে এসএসসিতে । নীপা এতোটাই পর্দাতে থাকতো যে এমা নীপার মুখমন্ডল দেখতে পেয়েছে তাদের পরিচয়েরও ছয় মাস পরে। একদিন ক্লাস শেষে রশনী, চমক , সাদিকা, ঐশী, অহনা, নকশী ও এমা সব বান্ধবী মিলে নীপার নেকাব টেনে খুলে মুখটা দেখবে বলে ঠিক করে। এতোদিন হয়ে গেলো নীপার চোখ ছাড়া অন্য কোনো কিছুই তারা দেখেনি। বার্থডে বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও শতচেষ্টা করে তারা নিতে পারেনি নীপাকে। পড়াশুনায় খুব ভালো না হলেও রশনী,চমক , সাদিকা, ঐশী, অহনা, নকশী ও এমাদের থেকে ভালো। যার জন্য সবার কাছে সে প্রিয়। সাইন্সের ছাত্রী সবাই। নীপা অংক আর পদার্থে বেশ ভালো। অনান্য বিষয়েও ভালো। সব বান্ধবী মিলে ঠিক করে একদিন ক্লাশ শেষে নীপার নেকাব টেনে খুলে ফেলার। সেদিন নীপার সেকি কান্না ! অথচ এখন কেমন যেন মনে হয় তাকে। আগে ছেলেদের দিকে মোটেও তাকাতো না আর এখন প্রতিটি ছেলের দিকে তাকিয়ে কাকে যেন খোঁজে। যে মেয়ে কোনদিন সেলফি তোলেনি, অথচ এখন কথায় কথায় সেলফি। এমাকে নীপা বলেছিল, নিজে যা না সেভাবে প্রকাশ করাকে বা নিজেকে বড় করে প্রকাশ করাকে সেলফি বলে।
অধ্যায় : তিন
বছরের পর বছর সময় দিয়ে একটি সন্তান গড়ে তোলে আর আধুনিকতার আড়ালে বাচ্চাদের জীবন ধ্বংশ করার সকল উপকরণ হাতের মুঠোয়। এই উপকরণের শীর্ষে মোবাইল ফোন। এই উপকরণের জন্য তরুণ-তরুণী বা যুবক-যুবতীদের নিয়ে যে শুধু সমস্যা তা না। সাবেক তরুণ-তরুণী বা যুবক-যুবতীদের নিয়েও সমস্যা বললে কম বলা হবে, বরং মহা সমস্যা বাঁধাচ্ছেন উনারা। সাবেক আর বর্তমান মিলে যে সমস্যা বাঁধাচ্ছেন এরা তো কাঁঠালের আঠা বললে কম বলা হবে বরং সিমেন্টের মত জমাট বাঁধাচ্ছেন। রাস্তাঘাটে চলাফেরায় দেখা যায় তরুণ-তরুণী বা যুবক-যুবতী বা সাবেক তরুণ-তরুণী বা যুবক-যুবতী মোবাইল ফোনের স্ক্রীনে তাদের চোখ, মাঝে মাঝে মিটমিট করে হাসছে আবার কখনও দাঁত বের করে হাসছে কেউবা মুচকি মুচকি হাসছেন। শতকরা ৯৯ ভাগই হাসে তাদের চ্যাটিংএ বা ম্যাসেজিংএ। এর অন্যতম কারণ ম্যাসেজ প্রেরণকারী ও ম্যাসেজ গ্রহণকারী কেউই সত্য কথা বলে না, মিথ্যা হলো এইসব চ্যাটিংএ বা ম্যাসেজিংএর মূল উপাদান। চ্যাটিংএ বা ম্যাসেজিংএ সকল বিবাহিত নারী-পুরুষ হয়ে যান অবিবাহিত। আর যারা বিবাহিত নারী-পুরুষ বলে পরিচয় দেয় তারা নিজেকে অসুখী দাবি করে থাকে। নিজের কোনো দুর্বল দিক বলে না, আর বললেও যে দুর্বল দিক বললে সহানুভূতি পাওয়া যাবে সেটাই বলে থাকে। আর এরা কথা বলে ধীরে ধীরে, সুন্দর করে নরম কন্ঠে, কন্ঠ নরমতুলার মত নরম। কন্ঠ শুনে আপনার মনে হবে সে যদি গানের চর্চা করতো তাহলে অনেক বড় শিল্পী হতে পারতো। এতো নরম ক›ঠ, আপনি বলতে বাধ্য হবেন “তোমার কন্ঠ মিষ্টি”। ম্যাসেজ আদান-প্রদানকারী মজার মজার কাল্পনিক কাহিনী আদান-প্রদান করতে থাকে। আর কাল্পনিক কাহিনী সব সময়ই মজার হয়ে থাকে। যার জন্য শুধু হাসে আর হাসে। মিটমিট করে হাসে, মুখ বুজে হাসে, দাঁত বের করে হাসে। আর এই চ্যাটিংএ বা ম্যাসেজিং যদি বিবাহিত সাবেক যুবক-যুবতীর মাঝে হয়ে থাকে তাহলে কথাই নাই, মহা মিথ্যা কাল্পনিক কাহিনীর আদান-প্রদান চরম আকার ধারণ করে, যে পারিবারিক কাল্পনিক অশান্তির কথা বলে তাদের চ্যাটিং বা ম্যাসেজিং এর সম্পর্ক গভীর করে সেই কাল্পনিক অশান্তি কিছুদিনের মাঝেই বাস্তবিক অশান্তিতে রূপ নেয়। এই চ্যাটিং বা ম্যাসেজিং মহামারীর আকার ধারণ করেছে। এই মহামারীর মাঝে খোকা সাহেবও পড়েছে।
মেয়েটাকে নিয়ে অশান্তি চলছে গত কয়েক দিন ধরে। অথচ মাস দুয়েক আগেও মেয়েটি ধর্ম-কর্ম মানতো, পর্দা ছাড়া বাইরে যেতো না। সেই মেয়ের যে কি হলো ধর্ম-কর্ম এলোমেলো হয়ে গেলো। পর্দা উড়ে গেলো আধুনিকতার মোবাইল ফোন ঝড়ে।। খোকা সাহেবের স্ত্রী কিছুতেই মেয়ের এসব আচরণ মেনে নিতে রাজি না। যদিও তিনি একজন লেখিকা, তার সর্বশেষ প্রকাশিত উপন্যাস “গল্পের প্লট” একটি প্রেমের উপন্যাস সুপার ডুপার হিট, কিন্তু নিজের মেয়ের প্রেম মেনে নিতে পারছেন না। তিন-চার দিন আগের ঘটনা। খোকা সাহেব রাতের খাবার খেয়ে ঘুমুতে যাবে এমন সময় তার স্ত্রী জেরিন তাকে মেয়ের ঘরে আসতে বলে। মেয়ের ঘরে যায় খোকা সাহেব। মেয়ের ঘরে অনেক দিন পর আসলেন। মেয়ের ঘরটা সুন্দর করে সাজানো থাকতো বরাবরই কিন্তু আজ বরই এলোমেলো-অগোছালো ঘরটা। তবে পড়ার টেবিল বেশ গোছানো, বই সুন্দর করে সাজানো অথচ আগে তার পড়ার টেবিলই থাকতো এলোমেলো-অগোছালো। উত্তরদিকের দেওয়ালে ছবি টাঙ্গানো। ছবিটা একজন ছেলের বোঝা যায় কিন্তু কার বোঝা যাচ্ছে না কারণ ছেলেটার পিছনের দিক করে ছবিটা তোলা, নদীর দিকে তাকিয়ে সূর্য ডোবা দেখছে ছেলেটি আর পিছন থেকে ছবিটা তোলা। অথচ মেয়েটা তার ঘরে তো নয়ই বাড়িতেই কোনো ছবি টাঙ্গাতে দিতো না। বলতো ছবি ঘর/বাড়িতে থাকলে ফেরেস্তা ঢোকে না। এ বাড়ির সকল ছবি সে সরিয়ে ফেলেছিল। খোকার ঘরের দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে কাজী নজরুল ইসলামের ছবি টাঙ্গানো ছিল। খোকার মনে পড়ে তার মেয়ের কথা, এ ছবির দিকের তাকিয়ে নীপা বলেছিল, “বাবা ছবি টাঙ্গিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করার কি কোনো কারণ আছে বাবা? তার জন্য দোয়া করো বাবা, এটা তার কাজে দিবে। নিজের ঘর থেকে ফেরেস্তা তাড়িয়ে দিয়ে গুণাহের কাজ করে অন্যের জন্য ভালোবাসা প্রকাশ! এটাকে কি ভালোবাসা বলে? না বাবা, বলে না।” সেই মেয়ের ঘরে ছবি তাও আবার একজন ছেলের, অবাক হয়ে যান খোকা সাহেব। এতো অল্প সময়ে এতো পরিবর্তন? মানতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে। ছবির দিকে তাকিয়ে নীপার দিকে তাকায়, মেয়ের সাথে চোখাচখি হয়। নীপা খুব দ্রুততার সাথে দক্ষিণ দিকে তাকায়। খোকাও দক্ষিণ দিকে তাকায়। হতভম্ব হয়ে যান তিনি। একটি মেয়ের ছবি টাঙ্গানো, ছবিটা মডেলের মত করে তোলা, প্রায় অর্ধউলঙ্গ। ভালো করে খেয়াল করে বুঝতে পারে এই মেয়েটা আর কেউ না তারই মেয়ে নীপা। নীপাও ছবিটির দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে। অথচ এই মেয়েটা তার মাকে পর্দার কথা কতো যে বলতো তার ইয়োত্তা নাই। পর্দার উপর একটা লেখাও আছে তার। মনে পড়ে তার সেই লেখার কথা। নীপা সেই লেখাতে লিখেছিল, “পানির ধর্ম নীচের দিকে গড়ানো, আগুনের ধর্ম উপরের দিকে উঠা, সূর্যের ধর্ম পূর্ব দিকে উদয় হয়ে পশ্চিমে অস্ত যাওয়া, চুম্বকের ধর্ম উত্তর মেরু উত্তরে থাকা দক্ষিণ মেরু দক্ষিণ থাকা, আলোর ধর্ম সোজা পথে চলা, মানুষের পায়ের ধর্ম পথ চলা-চলতে না পারলেই পা অচল, হাতের ধর্ম সবচেয়ে বেশী:মশা মাছি কামড়ালে বা সুড়সুড়ি দিলে দ্রুত হাত চলে যায়-হাত যদি ঠিকমত কাজ না করে তাহলে হাত অচল, চোখের ধর্ম সকল কিছু দেখা, সাতটি বর্ণের সমন্নয় করে মনের চাহিদা অনুযায়ী সঠিক বর্ণের সমন্নয়যুক্ত জিনিস নির্ণয় করা-এছাড়া চোখ অচল, জিহ্বা এর ধর্ম টক-ঝাল-মিষ্টি নির্ণয় করা-এছাড়া জিহ্বা অচল, এতো ধর্মযুক্ত অঙগের সমন্নয়ে যে মানুষ গঠিত তার কোনো ধর্ম থাকবে না এটা কোন যুক্তিতে হয়? ধর্ম ছাড়া মানুষও অচল। ধর্ম ছাড়া নারীরা একেবারেই অচল। নারীর পর্দা ধর্মেরই অংশ। প্রতিটি মানুষ তার সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ জিনিসকে লুকিয়ে রাখে। যতবেশি টাকা পরিবহন করে তত গোপণে নিয়ে যায়, যতবড় ধনীই হোক না কেন সে কোটি টাকা দুহাতে নিয়ে যায় না বরং ব্যাগে করে নিয়ে যায়-গোপণে নিয়ে যায়, প্রতিটি গৃহিনী তাদের রান্না করা তরকারি যা তারা নিজেরা খাবে তা কিন্তুু ঢেকে রাখেন মাছির ভয়ে, মিষ্টির বাটিও তারা ঢেকে রাখেন মাছির ভয়ে, দুধে বা পানিতে যদি মশা মাছি পড়ে সে পানি সহজে কেউ খায় না। প্রতিটি মানুষই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আড়াল করে রাখে অপরিচিত মানুষের নিকট হতে, আর গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বা বিষয়ই হোক না কেনো তা আপনজনের কাছে প্রকাশ করতে চায়। এটাও মানুষের ধর্ম। আর যে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বা বিষয় সকলের কাছে উন্মুক্ত থাকে আপনজনের কাছে সেইসব বিষয়ের মূল্য থাকে না। নারীর পর্দা যদি হয় বাইরে-পুরুষের পর্দা হতে হবে অন্তরে, নারীর পর্দা যদি হয় কন্ঠে -পুরুষের পর্দা হতে হবে কানে, নারীর পর্দা যদি হয় নেকাবে-পুরুষের পর্দা হতে হবে চোখে। নারীর পর্দা যদি হয় ঘরে থাকা, পুরুষের পর্দা হতে হবে অকারণে মোড়ে মোড়ে আড্ডা না দেওয়া। পর্দা মানেই শুধুমাত্র নারীকে কাপড় আবৃত করা না।” এই সেই মেয়ে নীপা যার এতো পরিবর্তন দেখে তার রাগ আসে না, হতাশা অনুভব করে খোকা।
মেয়ের ঘরে মেয়ের বড় মামা-মামী আগে থেকেই বসা ছিল। মামারা যেমন হয় নীপার বড় মামা সেরকমই মামা। ভাগিনা-ভাগিনীদের জন্য তার দরদের সীমা নাই। মিজান সাহেবের দরদ বটগাছের লতার মত ঝুলছে ভাগিনা-ভাগিনীদের জন্য। আর ভাগিনা-ভাগিনীরা বানরের মত লতার সাথে ঝুলছে। প্রচন্ড আদর যত্ন করে নীপাদের। নাম তার মিজান, ছয় ভাই বোনের মাঝে সে বড় সন্তান। বয়স খোকার সমবয়সী। মোটামুটি চাপা আর যুক্তির ভালো সমন্নয় করতে পারেন তিনি। একবার খোকার সামনেই একটা ঘটনা ঘটে। খোকার বাবার মিলাদের এক অনুষ্ঠানে মিজান একটি কঠিন কান্ড ঘটিয়ে বসে। গ্রামের বাড়িতে অনুষ্ঠান শেষে আত্মীয়-স্বজন সবাই বসে আছে সংগে মাওলানা সাহেবও। মিজান সাহেব এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সেজে গুজে যান। সেজেগুজে মানে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী, এটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলেও হতো, তিনি একটু বাড়তি যা করেন তা হলো নকল দাঁড়ি লাগান। এতে অবশ্য তার সৌন্দর্য বাড়ে। নকল দাঁড়ি বোঝার উপায় নাই। আর অপরিচিতরা তো পীর মনে করে তাকে।
সবাই বসে আছে, খোকাও। মিজান সাহেব চাপা মারতে মারতে বলে বসে আমরা নবীর বংশ।
মিজানের কথা শুনে সবাই ঝড়ের গতিতে মিজানের দিকে তাকায়। খোকাও তাকায় তার দিকে, তার গতি আলোর গতি। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই মাওলানা সাহেব খোকাকে বলে বসে, খোকা ভাই আপনি নবীর বংশের জামাই আমাদের বলবেন না?
খোকা বলে, না আমি নিজেও তো জানিনা, আপনাকে জানাবো কি করে?
এরই মাঝে উপস্থিত সবাই মিজানকে ঘিরে ধরে। সবাই বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করা শুরু করছে। মিজানও বেশ উৎসাহ নিয়ে তাদের কথা শুনছে। এসব কান্ড দেখে খোকাই জিজ্ঞাসা করে, “কেমন করে ভাইজান?”
“আহা নবীর বংশধর থাকতে আমার মিলাদ পড়ানো কি ঠিক হলো? দোয়া করানো কি ঠিক হলো? বেয়াদবী হলো না তো? আমাকে মাফ করে দেন হুজুর। “বলেই মাওলানা সাহেব মিজানের হাত চেপে ধরে। খোকা আবার জিজ্ঞাসা করে, “কোন নবী ভাইজান?”
মিজান কোনো উত্তর দেয় না। মাওলানা সাহেবকে বাদ দিয়ে সবাই তাকে হুজুর হুজুর বলছে। মিজান বিষয়টা বেশ ইনজয় করছে তা বুঝতে পারে খোকা । মুহূর্তের মধ্যে গ্রামে ছড়িয়ে যায় নবীর বংশধর এসেছে। এদেশের মানুষ রাজনৈতিক ভাবে যতোই জটিল হোক না কেন ধর্মীয় বিষয়ে একেবারেই সহজ সরল। খোকা ভাবে ভাগ্যভালো অনুষ্ঠানটা শেষ হয়েছিল। তা ছাড়া অনুষ্ঠানটা লন্ডভন্ড হয়ে যেত। গ্রাম ভেঙ্গে মানুষজন খোকার বাড়িমুখী, নবীর বংশধর দেখতে। খোকা দ্রুত জেরিনের কাছে যায়। ঘরের ভিতরে যেতেই খোকার কানে আসে, জেরিন বলছে “হ্যাঁ, হ্যাঁ, এ কথা কাউকে আমরা বলি না, বললে অহংকার করা হয়। দাদার মুখে শুনেছি দাদার দাদারা অনেক আগে ধর্ম প্রচার করতে এদেশে আসে। উনারা আসেন মদিনা থেকে..”
খোকা ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়। খোকাকে দেখে জেরিন থামে, একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে, “নীপার বাবাকেও বলেনি এসব বলার মত কথা না।”
খোকা আবার চলে আসে মিজানের কাছে। ততক্ষণে আছর গড়িয়ে মাগরিবের নামাজের সময় হয়ে যায়। জনতা মিজানকে গোল করে ঘিরে রেখেছে। মাগরিবের নামাজ খোকার বাসাতে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয় উপস্থিত মানুষজন। শুধু তাই নয় সবাই সিদ্ধান্ত নেয় নামাজ পড়াবে মিজান হুজুর। এপর্যন্ত সবই ঠিক ছিল কিন্তু নামাজ পড়ানোর সিদ্ধান্তের পর মিজানের মুখচোখ শুকিয়ে যায়। খোকা তো হেসেই কূল পায় না কারণ মিজান সাধারনত বছরে চার রাকাত নামাজ পড়ে। সে আবার নামাজ পড়াবে কেমন করে। এরই মাঝে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খোকাকে বলে,
“তুমি তো অনেক ভাগ্যবান, নবী বংশের জামাই।”
সবাই মিলে ঈমামতিতে দাঁড় করিয়ে দেয় মিজানকে। মিজান দাঁড়িয়েও যায়। ইকামত দেওয়া শেষ। মিজান কাঁপতে কাঁপতে বলে, “আমার অযু করতে হবে। অযুর কথা ভুলে গেছি।” যাই হোক অযু করতে যেয়ে মিজান হুজুর আর ফেরত আসেনি। কেউ না বুঝলেও খোকা বোঝে নামাজ পড়ানোর ভয়ে পালিয়ে যায় সে।
ঢাকাতে ফিরে খোকা জেরিনকে জিঙ্গাসা করে, “কেমন করে নবীর বংশধর তোমরা? ”
জেরিন বলে, “ভাইয়াকে জিজ্ঞাসা কর আমি জানিনা। এটা দিয়ে তুমি কি করবা, তোমার কাজ কি? তুমি তো নামাজই পড় না।”
“তুমি না বললে তোমার দাদার দাদারা মদিনা থেকে এসেছে” খোকা অবাক হয়ে বলে।
“হ্যাঁ বলেছি তো কি হয়েছে। ভাইয়া মিথ্যা বলে না। তবে আমরা নবী বংশ”
বেশ কিছুদিন পর মিজানের সাথে দেখা হলে খোকা জিজ্ঞাসা করে কেমন করে নবীর বংশধর আপনারা?
মিজান বেশ গম্ভীর হয়ে বলে, “তোমার কি ধারণা আমি মিথ্যা বলেছি?” থামে মিজান। মাথা দোলাতে থাকে, বোঝাতে চায় ভুল বুঝছে খোকা। “আরে শোনো খোকা। আমরা আদম (আ:) এর বংশধর। আমাদের বংশ আদমের বংশ। আমাদের র্পূব পুরুষ আরাফাত মক্কাতে থাকতো।”
উত্তর শুনে খোকা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না। মন চায় তার তাকে মারতে। এধরনের যুক্তিতে সে ওস্তাদ। অবশ্য খোকা মনে করে মিজানের এই চাপা আর যুক্তি শুধু তার পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
নীপা ঘরের এক কোনে বসে আছে, তার চোখে মুখে অপরাধীর ছাপ। খোকা সাহেবের স্ত্রীর মুখ-চোখে প্রচন্ড বিরক্তির ছাপ। সবাই কেনো জানি নীরব হয়ে বসে আছে।
বড় মামা নীরবতা ভেঙ্গে আমতা আমতা করতে করতে বলে, “নীপাকে নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছে। খোকা তুমি কি বিষয়টা জানো?”
খোকা সাহেব উত্তর দেওয়ার আগেই জেরিন বলেন, “আরে ও কি জানবে? ওতো কিছুই জানে না। ওই তো দামী মোবাইল সেট কিনে দিয়েছে। এই মোবাইল সেটই তো সব সমস্যার সৃষ্টি করেছে। ওতো পারে সমস্যা বাধাতে। কতবার বলেছি মোবাইল সেট বাচ্চাদের হাতে দিও না। মোবাইল সেট না কিনে দিলে এই সমস্যা হতো না।” জেরিনের কথাতে অভিযোগের সুর মেশানো।
“আ…..হা.. আগের কথা বলে তো আর সমস্যার সমাধান হবে না, সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যাবে সেটার উপায় বের করতে হবে” মামী বলে। মামী তো সেরকম মামী। বার্গার মামী বলেই সবাই ডাকে। বার্গার তার উপাধী, এরকম উপাধীতে তিনি কিন্তু খুশী। খোকাও একবার বার্গার ভাবী বলেছিল, তিনি এতো খুশী হয়েছিলেন যে ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল। বার্গার বললে খুব খুশী, যার জন্য খোকা তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ীকে বলে, বার্গার বউমা বলতে। শ্বাশুড়ীতো খুব সহজেই বার্গার বউমা বলে ফেলে কিন্তু খোকার শ্বশুর ছেলের বউকে বার্গার বউমা বলতে যেয়ে হেসেই কূল পায় না। কাউকে কাতুকুতু দিলে যে রকম হাসে ঠিক সেরকম হাসতে থাকেন খোকার শ্বশুর, মামা শ্বশুর। বার্গার মামীর আসল নাম পারভীন আক্তার। বার্গার পদবী পাওয়ার আগে উনার পদবী ছিল ফুগলি। তার সামনের দাঁত ছিল না, নকল দাঁত সেট করা ছিল। মিজানের বিয়ের জন্য যখন পারভীন আক্তারকে দেখতে গিয়েছিল তখন একটা মজার ঘটনা ঘটে। মিজানের বাবা-চাচা, খোকা আর মিজান গিয়েছিল দেখতে। সবাই যখন খাওয়া-দাওয়া করছিল তখন পারভীন আক্তারকেও খেতে বলে সবাই। পারভীন আক্তার মুখে আস্ত মিষ্টি ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু খেতে পারছিল না। মুখ বন্ধ করে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। মিজানের বাবা বলে, খাও মা খাও।
পারভীন আক্তার চুপ করে থাকে।
মিজানের বাবা আবার বলে, খাও মা খাও।
পারভীন একবারে আস্ত মিষ্টি গিলে ফেলে। খাওয়ার পর হাসতে চেষ্টা করে।
খোকা বলে, আর একটা খান।
পারভীন আক্তার হাসতে হাসতে বলে, না না আর খাবো না। বেশি মিষ্টি খাওয়া ভালো না। পারভীন আক্তার যখন কথা বলছিল খোকার দিকে তাকিয়ে ছিল। খোকার তাকিয়ে থাকা দেখে পারভীন আক্তার কথা বলা বন্ধ করে। খোকার কাছে মনে হচ্ছে উপরের মাড়ির সামনের একটা দাঁত নাই। সে মনে মনে ভাবে আগে তো এটা খেয়াল করলাম না। একটু আগেও তো ছিল। বিষয়টি খোকা তার শ্বশুরকে জানায়। মিজানের বাবা বলে, দেখি মা তোমার দাঁত দেখি।
পারভীন আক্তার দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে, দাঁত খেয়ে ফেলেছি।
মিজানের বাবা বলে, মানে? দাঁত আবার খাওয়া যায় নাকি।
পারভীন আক্তার বলে, না না, মিষ্টির সাথে দাঁত চলে গেছে।
খোকা হাসতে হাসতে বলে, নকল দাঁত।
সেই বার্গার মামীর কথা শেষ হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মামা বলে, “সেটাই, আমরা নীপার কাছ থেকে কথা শুনি।”
কৌতুহলী ও উৎকন্ঠিত খোকা সাহেব নীপার দিকে তাকিয়ে বলেন, “মানে” মুখ ঘুরিয়ে মিজানের দিকে তাকিয়ে বলে, কি হয়েছে নীপার?
জেরিন বলেন, “কেমন বাবা তুমি?“ থামে জেরিন। বড় বড় চোখ করে মেয়ের দিকে তাকান। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, দীর্ঘশ্বাসের সাথে ঠোঁট দুটা কাঁপতে থাকে। আবার শুরু করেন, “মেয়েকে দেখে বুঝতে পারো না? এটাও বলতে হবে?” আবার থামেন জেরিন।
উত্তেজিত ভাবে জেরিন বলেন, “নীপার কোনো কথা শুনার কিছু নাই। ওর মোবাইল সেট আগে নিয়ে নিতে হবে।”
খোকা সাহেব বলেন, “বিষয়টা কি আমাকে তো বলতে হবে।” থামেন তিনি, জেরিনের দিকে তাকিয়ে বলে তুমি তো আমাকে বিষয়টা জানাওনি। ভাই ভাবীকে তো ঠিকই জানিয়েছো। বিষয়টা তো আমাকে জানাবা তাই না?”
“ও আমি আমার ভাই ভাবীকে জানিয়েছি এটাই দোষ? ওরা কি আমাদের পর?” উত্তেজিত ভাবে জেরিন বলেন।
মামী বলে, “আপনারা থামেন। আমি বলি শুনেন।” দাঁড়িয়ে যান। দুই হাত রাজনৈতিক নেতাদের মত ঝাঁকিয়ে বলেন, “প্লিজ আপনারা থামেন, আমি বলি শুনেন, নীপার একজন ছেলের সাথে সম্পর্ক হয়। সম্পর্ক অনেক গভীর, সম্পর্ক কিছুতেই ছিন্ন করবে না নীপা, আমরা অনেক বুঝিয়েছি, অ..নে..ক..বু..ঝি..য়ে..ছি। বিষয়টি আপনাকে না জানিয়ে সমাধানের চে..ষ্টা করেছি, আপনি ব্যস্ত থাকেন, যার জন্য আপনাকে ঝামেলা দিতে চায় নাই জেরিন, আপনাকে যার জন্য জানানো হয় নাই, অন্য কিছু না ভাই। এর মাঝে জেরিনের উপন্যাসটি বেশ নাম করেছে এটাতো আপনি জানেনই। এখন অনেক বেশি ব্যস্ত। জেরিন এদিকে আগের মত সময় দিতে পারে না, নীপা কখন কি করে বসে এটা নিয়ে ভয় পাচ্ছি আমরা। আর জেরিন কিছুতেই এইসব সম্পর্ক মানবে না।” এটুকু বলতেই জেরিন থামিয়ে দেয় ভাবীকে, আর বলে, “প্রশ্নই আসে না এ সম্পর্ক মানার। কোথাকার কোন ফনি এর জন্য আমার মেয়ে পাগল? ও সব ফনি টনি বাদ দিতে হবে।”
এটুকু বলতেই দাঁড়িয়ে যায় নীপা, থামিয়ে দেয় তার মাকে। নীপা জেরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,“মা”, একটু থেমে থেকে তার মামীর দিকে তাকিয়ে বলে, “মামী” আবার থেমে থাকে নীপা কিছুক্ষন। রাগে তার নাক ফুলছে। আবার শুরু করে, “মা-মামী তোমরা এখন এসব বলছো কেনো? তোমরা দুজনই শুরু থেকে তো সবই জানতে, এখন বাঁধা……” কথা শেষ করতে পারে না নীপা।
“কী…” বলতে বলতে জেরিন আচমকা নীপার চুলের মুঠি ধরে বাম হাতে আর ডান হাতে গালে চড় মারতে থাকে আর বলতে থাকে, “এখন আমাকে জড়াচ্ছিস? তোর মামীকে জড়াচ্ছিস? মিথ্যা বলছিস?”
হতভম্ব হয়ে যান খোকা সাহেব। মেয়েকে চোরের মত করে মারতে দেখে ভীষণ অবাক। এ পর্যন্ত জীবনে মেয়েকে তিনবার তিনটি চর মেরেছেন। তিনি জানতেনই না তার স্ত্রী মেয়ের গায়ে হাত তোলেন। জেরিনের মারার ধরন দেখে বোঝা যায় নিয়মিত মেয়েকে মেরে থাকেন।
এরই মাঝে নীপা বলে, “আমি না মা, তুমি.. তুমি তুমিই মিথ্যা বলছো,”
এ কথা শোনা মাত্র জেরিন নীপার চুল ছেড়ে দুহাত দিয়ে গলা চেপে ধরে বলতে থাকে,“ তোকে আজ মেরেই ফেলব।”
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে খোকা সাহেব। মামা-মামী দাঁড়িয়ে আছে তারাও হতভম্ব। কিন্তু কেউই জেরিনকে থামাচ্ছে না। বরং মামা-মামী এক সাথেই বলে, “মেয়েটা চরম বেয়াদব।”
নীপা অসহায় চোখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।
তার বাবা এগিয়ে যাচ্ছে এমন সময় জেরিন বলে, “একদম আসবানা তুমি। ওর প্রেম আমি বের করছি। আমিই আজরাইল, ওর প্রেমের জান কবজ করবো। আজরাইল”
দম নিতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল নীপার। এক সময় এক ঝাটকা মারে তার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে। জেরিন ছিটকে পড়ে দেওয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় মেঝেতে। নীপা জোড়ে জোড়ে দম নিতে নিতে তার বাবার পিছনে এসে দাঁড়ায়। মামা-মামী এক সাথেই জেরিনকে ধরতে যায়। জেরিন জ্ঞান হারিয়েছে। জ্ঞান হারানো সবচেয়ে সহজ কাজ জেরিনের। প্রায় জ্ঞান হারায় জেরিন, এটা খুব ভালো করেই জানেন খোকা সাহেব। যার জন্য তার মাঝে বিন্দু মাত্র চিন্তার রেশ নাই। তিনি তার মেয়ের হাত ধরে তার নিজের ঘরে চলে যান।
খোকা সাহেব মেয়েকে বলে, “তুমি বসো মা, মাথা ঠান্ডা করো।”
: বাবা পানি খাবো।
: আচ্ছা বসো তুমি, আমি পানি আনছি।
পানি আনতে আনতে ভাবে কোনোদিনই মেয়েকে এক গ্লাস পানি এনে খাওয়ানো হয়নি, মেয়েটা কোনোদিন চায়ওনি। প্রচন্ড অপরাধবোধ কাজ করছে। মেয়েটার উপর প্রচন্ড অত্যাচার হয় তিনি বুঝতেই পারেননি।
পানি নিয়ে ঘরে ঢুকতেই মেয়েটা বলে, “সরি বাবা, তোমাকে অর্ডার করার জন্য”।
খোকা মাথা দোলাতে দোলাতে বলে, “নারে মা।”
পানি নিয়ে নীপা খেতে থাকে আর খোকা সাহেব বলে, “তোর মা কী এভাবেই মারে?”
নীপা কাঁদতে শুরু করে। শব্দ করে কাঁদছে। ছোট বেলাতে নীরবে কাঁদতো। এখন শব্দ করে কাঁদছে। অঝোরে পানি ঝরছে দুচোখ দিয়ে। এ কান্না প্রকৃত কান্না। অনেকেই কাঁদে শব্দ করে কিন্তু চোখে পানি নেই।
“হ্যাঁ বাবা” ডুকরে ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে বলে।
“বলিস কিরে মা? এভাবে নিজের মেয়েকে কেউ মারে নাকি?”
নীপা কান্না থামিয়ে দিয়ে বলে, “সেদিন কী করেছে জানো?”
“কী করেছে?” “মা আমার মুখে গরম দুধ ছুড়ে মেরেছে, অল্প গরম ছিল দেখে কোনো কিছু হয় নাই।”
খোকা বলে, “বলিস কিরে মা? আমাকে এতোদিন এসব বলিস নাই কেনো?”
“তোমাকে বলে কী হতো বাবা? তুমি কত সময় আর বাসাতে থাকো? সারাদিন বাসাতে আমরা থাকি, এখানে কি হয় তা তুমি জানো না বাবা। তোমাকে বললে আরও বেশি মার খেতে হতো।” নীপা তার বাবার দিকে তাকিয়ে আরও বলে, “বাবা মনে আছে তোমার? মামী যে আমাকে মেরেছিল সেই কথা?”
“হ্যাঁ, মনে আছে, থাকবে না কেনো?”
“বাবা, এ কথা তোমাকে বলায় মা আমাকে অনেক মেরেছিল।
গলাটিপে ধরে বলেছিল আর কোনোদিন যদি কোনো কথা তোর বাবাকে বলিস তাহলে গলা টিপে মেরে ফেলবো। যার জন্য আর বলিনি।”
এর মাঝে বারো বছর কেটে গেছে। মেয়ের কোনো খোঁজই রাখেনি সে। ব্যস্ততা তাকে কি দূরে সরিয়ে দিয়েছে সন্তানদের কাছ থেকে নাকি ব্যস্ততার নামে সন্তানদের ঝামেলা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে নিজে নিজেই। ভাবতে থাকে খোকা সাহেব। ছেলেটার যে কি অবস্থা আল্লাহই জানেন।
নীপা আবার শুরু করে, “দিন দিন মা-র অত্যাচার বেড়েই চলছে। তাছাড়া তোমার থেকে মায়ের আয় বেশি। মাঝে মাঝে তোমার তো অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়, তখন মা সংসার চালায়, এ জন্য মায়ের প্রভাব বেশি, এটা আমি বুঝি বাবা। যার জন্য অনেক কিছুই তোমাকে বলা হয় না বাবা। আর এখন তো বলা চলে মায়ের টাকাতেই সংসার চলে।”
খোকা সাহেব মাথা দুলিয়ে বলে, “হ্যাঁ, তা ঠিক। আমার টাকাতে তো বাসা ভাড়া দিতেই শেষ। এতো দামী বাসার কি দরকার ছিল? জনে জনে ঘর।”
খোকা মেয়েকে স্বাভাবিক করার জন্য চেষ্টা করছে। মেয়েটাকে ভালো করে খেয়াল করে দেখে, যে মেয়ের মাথা সব সময় ঢাকা থাকতো, এখন আর নাই। যে মেয়ে কোনদিনই নেইল পালিস দিতো না, তার হাত পায়ের নখে নেইল পালিস। মাথার চুলও কেটেছে মনে হয়। এতো পরিবর্তন। মেয়ের টেবিলে রাখা কোরাআনে চোখ পড়ে। সবুজ কাপড়ে মোড়ানো কোরআনুল মজিদ। ময়লার একটি প্রলেপ পড়েছে। ধূলাবালির প্রলেপ পড়েছে। খোকা সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে যায় কোরাআনুল কারীমের কাছে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে ,“কিরে মা কতদিন ধরে কোরাআনুল মাজিদে হাত দিস নাই? প্রতিদিনই কোরাআন পড়তি এটাও বাদ দিয়ে দিয়েছিসরে মা?”
মেয়ে চুপ করে থাকে। কোনো কথা বলে না। “আচ্ছা মা তুই তো অনেক দিন আমাকে নামাজ পড়ার কথা বলিস না। আগে তো প্রতিদিন বলতি। তুই কি নামাজও ছেড়ে দিয়েছিস?”
এমন সময় জেরিন বিদ্যুৎ গতিতে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, “নামাজ টামাজ বাদ দিয়েছে সেই কবে, এবার রমজানের রোজাও রাখেনি, কোরাআন পড়া ভুলে গেছে।” থামে জেরিন, স্বামীর দিকে বড় বড় চোখ করে বলে, “এর কোনো কথা তুমি বিশ্বাস করবে না” থামে জেরিন, মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “মিথ্যাবাদী প্রেম করতে যেয়ে লজ্জার মাথা খেয়েছিস, পর্দা করা বাদ দিয়েছিস, নামাজ ছেড়েছিস, রোজা বাদ দিয়েছিস, কোরাআন পড়া বাদ দিয়েছিস। তোর এতো অধ:পতন? তুই আমার মেয়ে না। খোকা তুমি এর কোনো কথা বিশ্বাস করো না।” বলেই চলে যায় জেরিন।
যেতে না যেতেই আবার বিদ্যুৎ গতিতে আসে জেরিন। খোকা সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ফনি একটা যাদুকর। তোমার মেয়েকে যাদু করেছে। সাবধান, ফনি যাদুকর থেকে। তুমি চলে আসো এই বেয়াদব মেয়ের সাথে কোনো কথা নাই। আজ আমার গায়ে হাত তুলেছে।” বলেই চলে যায় জেরিন।
খোকা সাহেব কোন কিছুই বলে না আর নীপাকেও কোনো কিছু বলতে নিষেধ করে। “মা তুই একটু বসে থাক আমি আসছি। জেরিনের আচরন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে।” বলেই চলে যায় খোকা। প্রায় এক ঘন্টা পর খোকা সাহেব ফেরত আসে। মেয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। রাতও অনেক হয়ে গেছে।
বাস্তবে খোকা সাহেবও রাগী। তিনি রাগ সামলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। মেয়ের অস্বাভাবিক বদলে যাওয়া আর স্ত্রীর অস্বাভাবিক এ আচরণেও যদি কারো রাগ না আসে তাহলে সে মফেল। আর যাই হোক খোকা সাহেব মফেল না।
চোখ বন্ধ করে খোকা সাহেব বলে, “তোমার মা ছেলেটাকে যাদুকর বললো কেনো?”
নীপা উত্তর দিতে যাবে কিন্তু তার বাবার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে তার কথা বলা শেষ হয় নাই। তাই সে চুপ করে থাকে। খোকা সাহেব চোখ মেলে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি হয়তো পিতা হিসাবে দায়িত্বশীল না…..” কথা শেষ করতে দেয় না নীপা বলে,
“বাবা এসব বলছো কেন?”
খোকা সাহেব আবার বলে, “তোমার মা ছেলেটাকে যাদুকর বললো কেনো?”
“আসলে বাবা ও না সব কিছু বলে দিতে পারে।” নীপা বেশ আগ্রহ সহকারে কথাটি বলে।
“কী” বলে মুখটা বাঁকা করে, এবার কপালটা ভাঁজ করে আবার বলে, “মানে কী”
“বাবা, আসলে বাবা..” বলে থামে নীপা, হাসি হাসি মুখ করে বলে, “বাবা ফনি সব কিছু বলে দিতে পারে, আমি কখন কী করি, আমি কখন কী খাই….” থামে নীপা, মাথা নীচু করে বলে, “জানো বাবা আরো অনেক কিছুই বলে দিতে পারে যেটা আমি তোমাকে বলতে পারবো না। আর আজ যে ঘটনা ঘটলো সব সে বলে দিতে পারবে।”
নীপার কথা শুনে খোকা সাহেবের চোখ কপালে উঠার উপক্রম সেই সাথে সাথে চোখও বেশ বড় হয়েছে তার। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে খোকা সাহেব বলে, “আজকের ঘটনা যা যা ঘটলো বলে দিতে পারবে?”
“হ্যাঁ বাবা পারবে” দৃঢ় কন্ঠে বলে নীপা।
বিষয়টা যেনো বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। ভাবছেন তার মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে অথবা মেয়েটা মিথ্যা বলছে। খোকা সাহেব বলে, “তুমি কী ছেলেটাকে দেখেছো?”
“না, বাবা” মাথা দুলিয়ে বলে নীপা।
“তুমি কী ছেলেটার সাথে কথা বলেছো?”
“না, বাবা” মাথা দুলিয়ে বলে নীপা।
“ছেলেটার সাথে যোগাযোগ হয় কিভাবে?”
“বাবা, এসএমএস এর মাধ্যমে, মোবাইল চ্যাটিং এ”
“তুমি কী ছেলেটার আত্মীয়কে চিনো?”
“না, বাবা” মাথা দুলিয়ে বলে নীপা।
“তোমার মা কী ছেলেটাকে চিনে?”
“জানিনা, বাবা” মাথা দুলিয়ে বলে নীপা।
“ছেলেটার সাথে পরিচয় কিভাবে?”
“ফেসবুকে, বাবা” বলে নীপা।
থামেন খোকা সাহেব। অনেক বড় একটা নি:শ্বাস ফেলে। দুই হাত দিয়ে নিজের মুখমন্ডল ঢেকে মাথা নিচু করে রাখে কিছ্ ুসময়। মাথা তুলে খোকা সাহেব বলে,” আজ রাতের সব ঘটনা বলে দিতে পারবে?”
সাবলীল ভাবে নীপা বলে, “হ্যাঁ বাবা পারবে।”
“সত্যিই পারবে? আমার বিশ্বাস হচ্ছে নারে মা।”
“অবশ্যই পারবে। সত্যিই পারবে।”
খোকা সাহেব বলে, “ঠিক আছে মা তোর মোবাইল নিয়ে আয় আমি নিজের চোখে দেখবো। আমি নিজে যাচাই করবো।”
নীপার চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠে। কারণ সে জানে ফনি সব বলে দিতে পারবে, তাদের ভালোবাসার গভীরতা বুঝাতে পারবে। দ্রুত তার মোবাইল ফোন নিয়ে বাবার সামনে আসে।
বাবা মেয়ে পাশাপাশি বসে। নীপা ফেসবুক চ্যাটিং এ যায়। ম্যাসেজ লিখার আগে নীপা বলে, “বাবা আমি বললে দেখো। তার আগে দেখবানা।”
একটু পড়ে নীপা বলে, “বাবা তুমি কী জানতে চাও বলো, আমি জিজ্ঞাসা করছি”
“লিখতো মা আজ কী কী ঘটনা হয়েছে?” খোকা সাহেব বলে।
নীপা এসএমএস লিখে পাঠায় তার বাবার কথা মত। জবাবের প্রতীক্ষায় বাবা মেয়ে তীর্থের কাকের মত। সময় যেতে থাকে আর নীপার মন খারাপ হতে থাকে। জবাব দিতে এতো দেরী ফনি করে না। আজ দেরী করছে। খোকা সাহেব বলে, “নারে মা, এবার মনে হয় জাদুকর ধরা খেয়েছে। মনে হয় পারবে না। আর এটা সম্ভবও না। কিছুতেই সম্ভব না।”
“না বাবা সম্ভব, অবশ্যই সম্ভব। আর যদি না পারে বলতে তাহলে আজ থেকে, এ মুহূর্ত থেকে ফনির সাথে সম্পর্ক শেষ” শক্ত চোয়ালে দৃঢ় কন্ঠে নীপা বলে।
মেয়ের কথাতে নড়েচড়ে বসে খোকা সাহেব। মুহূর্তের মধ্যে মেয়ের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মেয়ের কথাতে আশার আলো দেখতে পায় খোকা সাহেব। আনন্দ কন্ঠে বলে, “সত্যিই শেষ? সত্যিই ফনির সাথে সম্পর্ক শেষ” “হ্যাঁ। বাবা সত্যিই শেষ। সত্যিই ফনির সাথে সম্পর্ক শেষ।
আমি তোমার সাথে মিথ্যা বলছিনা বাবা।”
খোকা সাহেবও মেয়ের সাথে তাল দিয়ে বলে, “যা আমিও তোকে কথা দিচ্ছি আজ যদি ফনি সব বলতে পারে তাহলে……..” বাক্য শেষ করতে পারে না এর মাঝেই ম্যাসেজ আসার শব্দ বেজে উঠে। সংগে সংগে বাবা ও মেয়ের চোখ এক সাথে যায় মোবাইল ফোনের স্ক্রীনে।
নীপার চোখ জ্বল জ্বল করছে আনন্দে আর খোকা সাহেবের চোখও জ্বল জ্বল করছে বাক্যটি শেষ না করার আনন্দে। কারণ স্ক্রীনে লেখা উঠেছে “তোমার বিচার করতে তোমার মা-বাবা, মামা-মামী বসেছিল। তোমার মা প্রথমে তোমার চুলের মুঠি ও পড়ে তোমার গলা টিপে ধরেছিল। তোমার মাকে তুমি ঝাটকা মেরে ফেলে দিয়েছো। তোমার মা মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল তোমার মা। তোমার মামা-মামী মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায় আর তুমি যাও তোমার বাবার সাথে। এখনও তোমার সাথে তোমার বাবা আছে। তুমি তোমার বাবার কথা মত ম্যাসেজ দিচ্ছো। তোমার বাবা আমাকে যাচাই করছে। আগে তোমার বাবার সম্পর্কে যা বলেছি তা তাকে বলো না।”
সমস্ত লিখা পড়ে চোখাচোখি হয় বাবা-মেয়ের। খোকা সাহেব অবাক হয়ে তার মেয়ের দিকে চেয়ে আছে। এ অবাক হওয়ার কারণ কোনটা খোকা সাহেব নিজেও বুঝতে পারছে না। ম্যাসেজের শেষ বাক্য অর্থাৎ “তোমার বাবার সম্পর্কে যা বলেছি তা তাকে বলো না” তার মাঝে বাড়তি চিন্তা যোগ করেছে। মেয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে এখন নিজের জন্য চিন্তা হচ্ছে। তার ব্যর্থ প্রেম কাহিনীর কথা বললো নাকি আল্লাহই জানেন। সেটা যদি বলে থাকে তাহলে সে মেয়ের কাছে মফেল হয়ে যাবে। মেয়ের বিচার করতে এসে নিজে আসামীর কাঠগড়ায় নিজে দাঁড়াবে।
নীপা বলে, “বাবা কী ভাবছো? বললাম না সব বলে দিবে।”
“হ্যাঁ। সবই তো বলে দিলো।” মন চায় তার সম্পর্কে কী বলেছে সেটা জানতে, কিন্তু বলতে সাহস করে না।
“কিভাবে এসব বললোরে মা ”
“তা আমি জানিনা বাবা। ফনি বলে সম্পর্ক গভীর হলে একে-অন্যের সব কিছু বোঝা যায়, বুঝতে পারে, বলতে পারে।” থামে নীপা। চোখ বন্ধ করে বলে, “শুধু তাই না, আমি যা যা বলি সবই মিলে যায় তার সাথে। আমিও তাকে দেখতে পাই।” থামে নীপা। চুপ করে থাকে অল্প সময়। হঠাৎ কান্না জড়িত কন্ঠে বলে, “বাবা ফনি খুব ভালো ছেলে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি বাবা তোমার পছন্দ না হলে আমি ফনিকে ভুলে যাবো।”
খোকা সাহেবও মেয়ের দেওয়া চালেঞ্জ গ্রহন করে বলেছে “সত্যিই আমার পছন্দ না হলে তুমি ভুলে যাবে?”
নীপা কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, “হ্যাঁ আমি তোমাকে কথা দিলাম।”
“আচ্ছা ফনির ঠিকানা দিস আমাকে”।
“আচ্ছা বাবা দিবো”।
মেয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তার মাঝে উৎফুল্ল ভাব দেখে ভালোই লাগে খোকা সাহেবের। মেয়েকে স্বাভাবিক দেখে খোকা সাহেবের মাঝে উৎফুল্ল ভাব আসে। “আচ্ছা মা তুই তোর লেখাটা কি শেষ করতে পেরেছিস? ”
“না বাবা।”
“শোন মা তোর লেখার প্রতিভা কিন্তু ….” কথা শেষ করতে না দিয়ে নীপা বলে, “বাবা তুমি কিন্তু বেশী বলছো”।
“না মা তোর লেখা কিন্তু আমার মুখস্ত। এস এস সিতে পাট রচনা আর লেখা মুখস্ত যদিও তোর মায়ের লেখা তেমন পড়া হয় নাই।”
“সত্যিই বাবা মুখস্ত?”
“হুম শুনবি?”
“বলো বাবা”
———– চলবে ———–