টিভিটা চলে না। সেই সকাল থেকে নাড়াচাড়া করছে আদিল সাহেব। এখন মনে হচ্ছে ধরে একটা আছাড় দিলেই হয়তো ঠিক হয়ে যেত। যত্তসব নষ্ট যন্ত্রপাতি, দুই নাম্বারী জিনিস। দেখেছো বউ, তারগুলো পর্যন্ত জোড়াতালি দেওয়া।
‘একটু না হয় ঝিরঝির করতো তাই বলে টিভিটার এই হাল কেউ করবে? শোনো, ওইটার যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়নি, নষ্ট হয়েছে তোমার মাথা।’ লিপিকার কথা শুনে মেজাজটা খিটখিটে হলেও ও ঘর থেকে কন্যার অট্টহাসি শুনে অসহায়ের মতো নীরব হয়ে গেলেন আদিল সাহেব।
‘ওই ভাবে বসে না থেকে যাও একটি মিস্ত্রিকে ডেকে আনো। যা হবার তা তো হয়েই গেছে।’ বউয়ের কথা শুনে চোখ দুটোকে শুধু এদিক সেদিক করলেন। তারপর টেবিলের ওপর রাখা ঘড়িতে চোখ দিলেন। ১১টা ৪০ বাজে। হাতে বেশিক্ষণ সময় নেই। দুপুর ১টার আগেই জামালপুর রেল স্টেশনে উপস্থিত থাকতে হবে। ছেলের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। তন্ময় ঢাকা থেকে অগ্নিবীণা ট্রেনে আসছে। ডিএমসি তে চান্স পেয়েছে গত বছর। ডাক্তারি পড়াশোনা করার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে ছেলেটার। একটু আদর আপ্যায়ন আগের থেকে বেশি আশা করবে এটাই স্বাভাবিক। এমন ভুলোমনা হয়ে গেলে ধমক খেতে হবে কোন একদিন। এখন বুঝতে পারছে বউ কেন তখন থেকে রাগ দেখাচ্ছিলো। তড়িঘড়ি করে প্যান্ট, শার্ট গায়ে জড়িয়ে রুম থেকে যেই বের হতে যাবে অমনি খপ করে পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো লিপিকা। ‘সকালের নাস্তা রেডি করে রেখেছি। এভাবে পাগলের মত ছুটে যাচ্ছো কোথায়?’
‘এখন কি নাস্তা খাওয়ার টাইম? ছেলেটা স্টেশনে এসে পৌঁছানো মাত্রই বাড়ির দিকে রওনা করবে। তখন সব দোষ পড়বে আমার ঘাড়ে। সামনাসামনি মুখ দেখাবো কেমন করে? তন্ময় তো বলবে বাবা আমাকে রিসিভ করতে যায়নি। পড়াশোনার জন্য দূরে থাকি বলে মন থেকেও দূরে চলে গিয়েছি। তখন কেমন লাগবে বল দেখি?’
‘ওইসব বাজে চিন্তা মাথায় আনার মতো ছেলে ও আমার না। এখনো আসতে তিন ঘন্টা সময় বাকি আছে। তোমাকে অত তাড়াহুড়ো করতে হবে না।’ আদিল সাহেবের ক্ষীণ সন্দেহ। তিনি নিজে দেখলেন ১ ঘণ্টা সময় বাকি অথচ লিপিকা বলছে তিন ঘন্টা। ঘড়ি দেখিয়ে বউকে সতর্ক করতে যাবেন কী উল্টো নিজেই থ খেয়ে মেয়ের সামনে আবারো লজ্জা পেলেন।
লিপিকা হাসতে হাসতে মেয়েকে বলছে, ‘দেখলি তো তোর বাপের কাণ্ড! ওই নষ্ট ঘড়িটা নিয়ে কমপক্ষে ১০ বার এমন ঘটনা ঘটালো। এবার তাহলে বুঝ্ কাকে নিয়ে এই ২২টা বছর ধরে সংসার করে আসছি।’
২.
‘এই রিকশা যাবেন ঐদিকে?’
‘যাবো। কোথায় নামবেন?’
‘স্টেশনে।’ ‘ত্রিশ টাকা দিয়েন।’
‘দশ টাকার ভাড়া চাচ্ছেন ত্রিশ টাকা! এইজন্যই তো রিকশায় যেতে মন চায় না। অটোরিকশায় যাবো পাঁচ টাকা খরচ করে, আপনি যান।’
‘উঠুন।’
আদিল সাহেব অবাক হলেন। তাই বলে দশ টাকায় রাজি হয়ে যাবে! পনের অথবা বিশ টাকা হলে তো মন্দ হতো না। তাছাড়া তিনি তো সেটা দেবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন-ই। রিকশায় চড়ে এ ব্যাপারটা নিয়ে একটা প্রশ্ন ছুঁড়লেন।
‘আমাকে দেখে কি আপনার গরীব বলে মনে হচ্ছে?’
ওমা! বলে কী এই লোকটি? মনে হচ্ছে পাগলের পাল্লায় পড়েছেন আজ। ভয় হচ্ছে কখন যে বড় গাড়ির নীচে ফেলে মারবে।
‘আমি বলছি একটু আস্তে চালান। আর আপনি ধনী না গরীব সেটা জেনে আমার কী লাভ? আমাকে দয়া করে গন্তব্যে পৌঁছে দিন তাহলেই হবে।’
‘কিন্তু আমাকে অবজ্ঞা কেন করছেন ভাইজান? একদিন আমিও তো আপনার মতই ছিলাম। মা বাবা বউ সন্তান সবাইকে হারিয়ে এখন আমার এই অবস্থা।’
‘সবাইকে হারিয়েছেন তো ভালো কথা। এখন রিকশা চালাচ্ছেন কেন?’ কত যে পাগল ছাগল এই শহরে আনাগোনা করে, এদের যন্ত্রণায় নিজেই একদিন পাগল হয়ে যাবেন আদিল সাহেব। মনে মনে কথা গুলো যখন আওড়াচ্ছেন তখন রিকশাওয়ালা কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো, ‘আপনি কি কখনো চোখের সামনে নিজের পরিবারকে আগুনে পুড়তে দেখেছেন? আমি দেখেছি ভাইজান। একটা উঁচু বিল্ডিং এ কীভাবে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়, তারপর পুরো বিল্ডিং এ আগুন দাউদাউ করে জ্বলে। একসাথে শত পরিবার সেই আগুনে পুড়ে কীভাবে ভস্ম হয়ে যায়, সব দেখেছি। চিৎকার শুনেছি পুড়ে যাওয়া মানুষের। মালিবাগের পাশেই দশ তলা একটা বিল্ডিংয়ের মালিক ছিলাম আমি। দ্বিতীয় তলায় সপরিবারে থাকতাম। আমার ছেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করত আর সেদিনই তার বাড়িতে আসার কথা ছিল। ভাগ্যক্রমে ছেলেকে রিসিভ করার জন্য স্টেশনে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পথিমধ্যেই একটা দুঃসংবাদ পাই। আমার বাড়িতে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন লেগেছে।’
এতক্ষণে গলা শুকাতে শুরু করেছে আদিল সাহেবের। তিনি বেশ অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলেন। এই লোকটি কোনভাবে তার নিজের পরিচয় কে অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন বানানো ঘটনা বর্ণনা করছে না তো? কিন্তু আদিল সাহেবের নিজের পরিচয়ের সাথে এই লোকটির কী সম্পর্ক? ‘আপনার পরিবারের এমন দুর্দশা হয়েছে বুঝলাম, কিন্তু আপনার ছেলে কোথায়? সেদিন যে স্টেশনে আসার কথা ছিল, আসেনি?’
‘না। পথে রেল দূর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। এখন আর কেউ অবশিষ্ট নেই। শুধু একা বেঁচে আছি আমি। মনের কষ্ট কিছুটা দূর করার জন্য এভাবে পথে পথে রিকশা চালাই। টাকার অভাবে পড়লে মাঝেমধ্যে ভিক্ষাও করি। রেললাইনের পাশে বসে চানাচুর বিক্রি করি আর আদরের মানিক ছেলেটার জন্য মসজিদে শিন্নি দেই। আমার ছোট মেয়েটা কবিতা লিখতে ভালোবাসতো। জানেন ভাইজান, টোকাইদের নিয়ে গল্প ছড়া লিখতো আর আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো, জানো বাবাএদের দিকে কেউ তাকিয়ে দেখে না। আমার মেয়েটির কথা মনে পড়লে বুক ফেটে কান্না পায়। মাঝেমধ্যে ছোট বাচ্চা টোকাইদেরকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে সন্তানের মতো আদর করি, স্টেশনের একপাশে গিয়ে পেপার বিছিয়ে একসঙ্গে ঘুমাই। প্রতিদিন মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দিন গুনি। কিন্তু আজরাইল আমায় চোখে দেখে না।’
লোকটির কথাগুলো শুনতে শুনতে আদিল সাহেবের চোখে পানি এসে গেল। শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। সামনেই স্টেশন। রিকশা থেকে নামতে গিয়ে বললেন, ‘আপনাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা আমার নেই। আপনার মত আমারও একটি ছোট মেয়ে আছে গল্প ছড়া লিখতে খুব ভালবাসে। শুধু একটা জিনিস বলতে ইচ্ছে করছে, আপনার সাথে আমার অনেক কিছুই মিল আছে।’
‘সবকিছু মিলে গেলেই বা কী আসে যায় বলুন! আমার দুঃখ তো আর আপনাকে দিতে পারবো না।’
‘তা ঠিক বলেছেন। আচ্ছা, আপনার নামটা কি শুনতে পারি?’
‘সবাই আগে আদিল সাহেব বলে ডাকত। কিন্তু এখন পাগল বলে ডাকে।’
‘আদিল সাহেব! এটা কী করে সম্ভব?’ কিছুক্ষণ মাথা চুলকিয়ে তারপর আবার প্রশ্ন করলেন,‘আমার ছেলেও ডাক্তারি পড়াশোনা করছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই এই স্টেশনে এসে নামবে। আপনার ছেলের নামটা কী দয়া করে বলবেন?’
‘তন্ময়’
আদিল সাহেব এবার পুরোপুরি বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। আর এক মুহূর্তের জন্যও এই স্থানে থাকার ইচ্ছা করছে না। দ্রুত ভাড়াটা মিটাতে গিয়ে খেয়াল করলেন মানিব্যাগ নেই। বাসায় কি তাহলে ফেলে এসেছেন? হঠাৎ পেছন থেকে উনার ছেলে তন্ময় কাঁধে হাত দিয়ে বললো, ‘তোমার কি হয়েছে বাবা? তুমি কি কিছু খুঁজছো? মানিব্যাগ কিন্তু আমার কাছে আছে। লাগলে জানিও।’
আদিল সাহেবের হার্টবিট বেড়ে গেল। মনে হচ্ছে এখনই স্ট্রোক করে মারা যাবেন। এ কেমন বিভ্রম শুরু হয়েছে! সত্যি সত্যিই তন্ময় উনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেকে বললেন, ‘আমার শরীরটা ঠিক লাগছে না। লোকটাকে দশ টাকা বাড়িয়ে বিশ টাকা দিয়ে দ্রুত বিদায় করে দাও।’
‘কোন লোক? কাকে বিশ টাকা দিব? তুমি কার কথা বলছো বাবা?’
ছেলের কথা শুনে পেছন দিকে অমনি তাকিয়ে দেখলেন আদিল সাহেব। আসলেই তো এখানে কেউ নেই। লোকটি তাহলে গেল কোথায়?
তন্ময় বাবার শরীরটাকে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে বললো- ‘এখানে কেউ ছিল না বাবা। আমি কিছুক্ষণ আগেই ট্রেন থেকে নেমে এসেছি। মা হয়তো আমাদের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। তোমাকে অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি আনমনে কার সাথে যেন বিড়বিড় করে কথা বলছিলে। দ্রুত বাড়ি যাই চলো। এই স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না।’
চোখ দুটো যে এখন পর্যন্ত কোটর থেকে বেরিয়ে আসেনি সেটাই রক্ষে। ছেলের হাত চেপে ধরে আরেকটু শক্ত হওয়ার চেষ্টা করলেন বাবা। মাথার ঘাম পা দিয়ে বেয়ে নামছে। তন্ময় ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে বাবার মাথাটা ধুয়ে দিলো। কিছুটা প্রশান্তি লাগছে। রুমাল দিয়ে মাথাটা মুছতে যাবেন তখনি আদিল সাহেবের ফোন বেজে উঠলো পকেটে।
‘কোথায় তুমি? তন্ময় একাই বাসায় ফিরে এসেছে। তোমাকে খুঁজছে। দ্রুত বাসায় আসো।’
বউয়ের কথা শুনে তিনি আর সহ্য করতে পারছেন না। পাশে তাকিয়ে দেখলেন একটা টোকাইয়ের হাত চেপে ধরে আছেন। চিৎকার দিয়ে হাত ছেড়ে দৌড় শুরু করলেন পেছনের দিকে। স্টেশনের একপাশ থেকে অন্যপাশ, তারপর রাস্তায়। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছেন, কেন হাঁটছেন বলতে পারেন না। ঠিক সেই সময় পেছন থেকে এক পুলিশ দৌড়ে এসে উনাকে শাসালেন, ‘আবার যদি রাস্তার মাঝখানে দিয়ে রিকশা চালাতে দেখি এক্কেবারে থানায় নিয়ে যাবো।’
আদিল সাহেব কিন্তু কিছুই বুঝলেন না। আরেকটু এগিয়ে যেতেই গোঁফওয়ালা এক ভদ্রলোক রাস্তার পাশ থেকে ডাক দিয়ে বললো, ‘এই রিকশা যাবেন ঐদিকে?’
ফজলে রাব্বী দ্বীন
শিক্ষার্থী
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট)।
জয়দেবপুর, গাজীপুর। মোবা: ০১৭৯১৪৮৭২১৮