ঢাকা ০৫:৩১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পেশাজীবীদের চিত্ত হোক জাগ্রত ও ভয়শূন্য

  • নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ১১:২৫:০৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
  • ৩৯ বার পড়া হয়েছে

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ কবিতা লিখেছিলেন ১৯১৩ সালে। ভারতবর্ষ তখন পরাধীন। তিনি স্রষ্টার কাছে চেয়েছিলেন তাঁর দেশ (দেশের মানুষ) যেন জাগ্রত হয়। দেশের জনগণ যেন দ্বিধা, ভয়, সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারে। তাঁর সে প্রার্থনা স্রষ্টা কতটুকু শুনেছেন জানি না তবে এটা বলতে দ্বিধা নাই যে, আমাদের এই জনপদের মানুষের চিত্ত এখনও ভয়কে জয় করতে পারেনি। তাঁরা দ্বিধা সংকোচের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। পারলে আজকে এই জনপদের মানুষের ভাগ্য ভিন্নরকম হতে পারতো। আমাদের আজকে গণতন্ত্রের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করতে হত না। দীর্ঘদিন ইংরেজদের দ্বারা শাসিত হয়ে আমরা নিজেদেরকে এখনো প্রজার জায়গায় দেখতে পছন্দ করি একই সাথে কাউকে রাজাও মেনে নিয়েছি। সেই রাজা বা তাঁর সভাসদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বলতে আমরা নারাজ, তা সে যতই সত্য বা সময়োপযোগী হোক না কেন। পাছে রাজা অখুশি হোক তা আমরা চাই না । এই না চাওয়ার পিছনে মূলত দুটি কারণ আছে বলে আমি মনে করি, এক. বিপদগ্রস্থ হবার ঝুঁকি আমরা নিতে চাই না । দুই. বিবেক দ্বারা পরিচালিত হলে কিছু বাড়তি সুবিধা বঞ্চিত হবার আশঙ্কা থাকে যা বরং তোষামোদ করলে নির্ঘাত পাওয়া যায়।

সাধারণত দেখা যায়, সমাজে যারা শিক্ষিত, যাদের কাছে মানুষ ভাল কিছু প্রত্যাশা করে, যাদেরকে মানুষ অনুসরণ করতে চায়, তাঁদের একটা বড় অংশ শাসক গোষ্ঠীর মোসাহেবি করতে থাকে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এদের সম্পর্কে যথার্থই বলেছিলেন-

“সাহেব (হুজুর) কহেন চমৎকার !
মোসাহেব বলে,
চমৎকার সে হতেই হবে যে ! হুজুরের মতে অমত কার ?”

এই মোসাহেবি কখনো এতটাই বেড়ে যায় যে, যত মন্দ কাজই সমাজে বা দেশে সংঘটিত হোক না কেন, এই মোসাহেবরা বেশ ভাল, বেশ ভাল বলে শাসক গোষ্ঠীকে বাহবা দিতে থাকে । এতে করে তাঁদের ভাগ্যের ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট কিছু জোটে বটে, কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ অধিকার বঞ্চিত থেকে যায়। অন্যায় মুখ বুজে মেনে নেয়ার মত অভিশাপ থেকে তাঁদের মু৩ি মেলে না। কারণ যারা রাজা সেজে থাকে বা যারা অন্যায় ও অনৈতিক কাজ করে, তারা অত্যন্ত সংগঠিত। একজন যা বলে, অন ̈রা সমস্বরে বিভিন্ন জায়গা থেকে একই কথা বলতে থাকে, ফলে মিথ্যা কথাও সত্যের মত শোনায়। সাধারণ ভাগ্যহত মানুষ বিভ্রান্ত হয়। জনসাধারণ আরও বিভ্রান্ত হয় শিক্ষিত মোসাহেবদের ভাঁড়ামির কারণে। জনগণ বুঝতে পারেন না কি তাদের করা উচিত। যে শিক্ষিত সমাজের কাজ ছিল দেশের শিক্ষা বঞ্চিত, অধিকারবঞ্চিত মানুষদের সঠিক তথ্য জানানো, তাদেরকে তাদের অধিকার সচেতন করবার, তারাই তো প্রতিনিয়ত জনগণকে বিভ্রান্ত করে চলেছে। অন্যদিকে যারা বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয় বা সত্য বলার চেষ্টা করেন, তাঁরা ভাল মানুষ। কিন্তু এই ভাল মানুষদের প্রধান সমস্যা তাঁরা সংখ্যায় নগণ্য এবং তাঁরা সংগঠিত হতে পারেন না। তাঁরা বিচ্ছিন্নভাবে যা কিছু বলেন তার খুব সামান ̈ই মোসাহেবি মিডিয়ায় গুরুত্ব পায়। নেপোলিয়নের সেই বিখ্যাত উক্তি এখানে প্রণিধানযোগ্য, তিনি বলেছিলেন,

”The world suffers a lot,
not because of the violence of bad people,
but because of the silence of good people.”

খারাপ মানুষদের কারণে আমাদের যতটা দুর্ভোগ পোহাতে হয় তার চেয়ে অনেক বেশী দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ভাল মানুষদের নীরবতা বা প্রতিবাদহীনতা। ভাল মানুষের এই দুর্বলতার কারণে অন্যায়কারীরা অন্যায় করতেই থাকে, ক্ষমতাবান হতেই থাকে আর জনগণ দুর্বল হতেই থাকে। এই চিত্র সর্বত্রই বিরাজমান। ভাল মানুষদের এই সমন্বয়হীনতার কারণে সমাজে প্রতিবাদহীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এই প্রতিবাদহীনতাই দেশ বা সমাজে অনৈতিক ও খারাপ কাজের বিস্তারে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত ভয়ংকর খারাপ কাজ সংঘটিত হলেও অধিকাংশ মানুষ এ কারণে নির্লিপ্ত বা উদাসীন থাকে। যেন কিছুই হয়নি, দেখিনি, শুনিনি অবস্থা। শুধুই নিজে ভাল থাকাতেই যেন তাঁদের একমাত্র সার্থকতা। এই মনোবৃত্তির পরিণতি মারাত্মক হতে বাধ্য। প্রতিবাদহীন সমাজে কেউ ভাল থাকতে পারে না। এর কুফল সবাইকে ভোগ করতে হয়। দুদিন আগে অথবা পরে। প্রতিবাদহীনতার এই বলয় থেকে বের হতে হলে, শুধু ভাল রাজনীতিবিদদের উপর দায়িত্ব দিয়ে বসে থাকলে চলবে না। নানাবিধ কারণে রাজনীতির প্রতি মানুষ বীতশ্রদ্ধ। ফলে তারা জনগণকে তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সম্পৃক্ত করতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে আমরা যারা সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব করি তাঁদেরকে সোচ্চার হতে হবে। বিভিন্ন পেশাজীবীদের এগিয়ে আসতে হবে। পেশাজীবীদের এদেশের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে, শাসকদের প্রতি নয়। তাঁদেরকে বিবেক দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। জনগণের সাথে মিশতে হবে, ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, দায়িত্ব সচেতন করতে হবে। জনসাধারণকে বোঝাতে হবে দেশের প্রকৃত মালিক তারা। এই মালিকানার ক্ষমতা তাদেরকেই সংরক্ষণ করতে হবে এবং সময়মত প্রয়োগ করতে হবে। আমি তাই পেশাজীবীদের জন্য বিশ্বকবি রবীন্দধনাথ ঠাকুরের সাথে তাল মিলিয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, আমাদের চিত্ত হোক ভয়শূন্য, জাগ্রত হোক বিবেক, মুক্ত হোক মন।

 

ড. এস.এম. আব্দুর রাজ্জাক
Senior Member, IEEE & Fellow, IEB
Professor
Department of Electrical and Electronic Engineering
Rajshahi University of Engineering & Technology

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

পেশাজীবীদের চিত্ত হোক জাগ্রত ও ভয়শূন্য

আপডেট সময় ১১:২৫:০৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ কবিতা লিখেছিলেন ১৯১৩ সালে। ভারতবর্ষ তখন পরাধীন। তিনি স্রষ্টার কাছে চেয়েছিলেন তাঁর দেশ (দেশের মানুষ) যেন জাগ্রত হয়। দেশের জনগণ যেন দ্বিধা, ভয়, সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারে। তাঁর সে প্রার্থনা স্রষ্টা কতটুকু শুনেছেন জানি না তবে এটা বলতে দ্বিধা নাই যে, আমাদের এই জনপদের মানুষের চিত্ত এখনও ভয়কে জয় করতে পারেনি। তাঁরা দ্বিধা সংকোচের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। পারলে আজকে এই জনপদের মানুষের ভাগ্য ভিন্নরকম হতে পারতো। আমাদের আজকে গণতন্ত্রের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করতে হত না। দীর্ঘদিন ইংরেজদের দ্বারা শাসিত হয়ে আমরা নিজেদেরকে এখনো প্রজার জায়গায় দেখতে পছন্দ করি একই সাথে কাউকে রাজাও মেনে নিয়েছি। সেই রাজা বা তাঁর সভাসদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বলতে আমরা নারাজ, তা সে যতই সত্য বা সময়োপযোগী হোক না কেন। পাছে রাজা অখুশি হোক তা আমরা চাই না । এই না চাওয়ার পিছনে মূলত দুটি কারণ আছে বলে আমি মনে করি, এক. বিপদগ্রস্থ হবার ঝুঁকি আমরা নিতে চাই না । দুই. বিবেক দ্বারা পরিচালিত হলে কিছু বাড়তি সুবিধা বঞ্চিত হবার আশঙ্কা থাকে যা বরং তোষামোদ করলে নির্ঘাত পাওয়া যায়।

সাধারণত দেখা যায়, সমাজে যারা শিক্ষিত, যাদের কাছে মানুষ ভাল কিছু প্রত্যাশা করে, যাদেরকে মানুষ অনুসরণ করতে চায়, তাঁদের একটা বড় অংশ শাসক গোষ্ঠীর মোসাহেবি করতে থাকে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এদের সম্পর্কে যথার্থই বলেছিলেন-

“সাহেব (হুজুর) কহেন চমৎকার !
মোসাহেব বলে,
চমৎকার সে হতেই হবে যে ! হুজুরের মতে অমত কার ?”

এই মোসাহেবি কখনো এতটাই বেড়ে যায় যে, যত মন্দ কাজই সমাজে বা দেশে সংঘটিত হোক না কেন, এই মোসাহেবরা বেশ ভাল, বেশ ভাল বলে শাসক গোষ্ঠীকে বাহবা দিতে থাকে । এতে করে তাঁদের ভাগ্যের ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট কিছু জোটে বটে, কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ অধিকার বঞ্চিত থেকে যায়। অন্যায় মুখ বুজে মেনে নেয়ার মত অভিশাপ থেকে তাঁদের মু৩ি মেলে না। কারণ যারা রাজা সেজে থাকে বা যারা অন্যায় ও অনৈতিক কাজ করে, তারা অত্যন্ত সংগঠিত। একজন যা বলে, অন ̈রা সমস্বরে বিভিন্ন জায়গা থেকে একই কথা বলতে থাকে, ফলে মিথ্যা কথাও সত্যের মত শোনায়। সাধারণ ভাগ্যহত মানুষ বিভ্রান্ত হয়। জনসাধারণ আরও বিভ্রান্ত হয় শিক্ষিত মোসাহেবদের ভাঁড়ামির কারণে। জনগণ বুঝতে পারেন না কি তাদের করা উচিত। যে শিক্ষিত সমাজের কাজ ছিল দেশের শিক্ষা বঞ্চিত, অধিকারবঞ্চিত মানুষদের সঠিক তথ্য জানানো, তাদেরকে তাদের অধিকার সচেতন করবার, তারাই তো প্রতিনিয়ত জনগণকে বিভ্রান্ত করে চলেছে। অন্যদিকে যারা বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয় বা সত্য বলার চেষ্টা করেন, তাঁরা ভাল মানুষ। কিন্তু এই ভাল মানুষদের প্রধান সমস্যা তাঁরা সংখ্যায় নগণ্য এবং তাঁরা সংগঠিত হতে পারেন না। তাঁরা বিচ্ছিন্নভাবে যা কিছু বলেন তার খুব সামান ̈ই মোসাহেবি মিডিয়ায় গুরুত্ব পায়। নেপোলিয়নের সেই বিখ্যাত উক্তি এখানে প্রণিধানযোগ্য, তিনি বলেছিলেন,

”The world suffers a lot,
not because of the violence of bad people,
but because of the silence of good people.”

খারাপ মানুষদের কারণে আমাদের যতটা দুর্ভোগ পোহাতে হয় তার চেয়ে অনেক বেশী দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ভাল মানুষদের নীরবতা বা প্রতিবাদহীনতা। ভাল মানুষের এই দুর্বলতার কারণে অন্যায়কারীরা অন্যায় করতেই থাকে, ক্ষমতাবান হতেই থাকে আর জনগণ দুর্বল হতেই থাকে। এই চিত্র সর্বত্রই বিরাজমান। ভাল মানুষদের এই সমন্বয়হীনতার কারণে সমাজে প্রতিবাদহীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এই প্রতিবাদহীনতাই দেশ বা সমাজে অনৈতিক ও খারাপ কাজের বিস্তারে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত ভয়ংকর খারাপ কাজ সংঘটিত হলেও অধিকাংশ মানুষ এ কারণে নির্লিপ্ত বা উদাসীন থাকে। যেন কিছুই হয়নি, দেখিনি, শুনিনি অবস্থা। শুধুই নিজে ভাল থাকাতেই যেন তাঁদের একমাত্র সার্থকতা। এই মনোবৃত্তির পরিণতি মারাত্মক হতে বাধ্য। প্রতিবাদহীন সমাজে কেউ ভাল থাকতে পারে না। এর কুফল সবাইকে ভোগ করতে হয়। দুদিন আগে অথবা পরে। প্রতিবাদহীনতার এই বলয় থেকে বের হতে হলে, শুধু ভাল রাজনীতিবিদদের উপর দায়িত্ব দিয়ে বসে থাকলে চলবে না। নানাবিধ কারণে রাজনীতির প্রতি মানুষ বীতশ্রদ্ধ। ফলে তারা জনগণকে তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সম্পৃক্ত করতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে আমরা যারা সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব করি তাঁদেরকে সোচ্চার হতে হবে। বিভিন্ন পেশাজীবীদের এগিয়ে আসতে হবে। পেশাজীবীদের এদেশের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে, শাসকদের প্রতি নয়। তাঁদেরকে বিবেক দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। জনগণের সাথে মিশতে হবে, ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, দায়িত্ব সচেতন করতে হবে। জনসাধারণকে বোঝাতে হবে দেশের প্রকৃত মালিক তারা। এই মালিকানার ক্ষমতা তাদেরকেই সংরক্ষণ করতে হবে এবং সময়মত প্রয়োগ করতে হবে। আমি তাই পেশাজীবীদের জন্য বিশ্বকবি রবীন্দধনাথ ঠাকুরের সাথে তাল মিলিয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, আমাদের চিত্ত হোক ভয়শূন্য, জাগ্রত হোক বিবেক, মুক্ত হোক মন।

 

ড. এস.এম. আব্দুর রাজ্জাক
Senior Member, IEEE & Fellow, IEB
Professor
Department of Electrical and Electronic Engineering
Rajshahi University of Engineering & Technology