বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি দেশে ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্র সড়ক পথে পণ্য বা মানুষ পরিবহনের উপর নির্ভরশীল। সড়কপথে চলন্ত অবস্থায় দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হওয়া সে সব ঝুঁকির মধ্যে সর্বাধিক গুরুতর এবং এসব সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার সর্বাধিক। দু:খজনক হলেও সত্য যে, এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা আশংকাজনক। প্রতিদিন আমাদের দেশে কোন না কোন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে ফলে অগনিত মানুষ আহত হচ্ছে এবং কারো কারো প্রাণহানিও হচ্ছে।
সড়কপথে চলন্ত অবস্থায় ঘটতে পারে এমন সব দুর্ঘটনার হারও মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে নিরাপত্তা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে পরিবহন সংক্রান্ত বিধি ও নীতিমালা উভয়ের মাঝে সামঞ্জস্য গঠনে সহায়ক করা অতি জরুরী।
নিরাপত্তা সংক্রান্ত মুখ্য যে, সকল বিষয় গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে সবচেয়ে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি হ্রাস করা যেতে পারে সেটি নিয়ে এই আলোচনা। এখানে শুধুমাত্র প্রশাসনের উপর একক দায়ভার না চাপিয়ে যানবাহন পরিচালনার সাথে সম্পৃক্ত সকল মালিক, তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট আইনি প্রক্রিয়াসমূহ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে এবং এ গুলো সকল সময় মেনে চলতে হবে। প্রশাসনের দায়িত্ব হলো রাস্তায় যানচলাচলের ন্যূনতম উপযোগী করে নিয়মিত মেরামতের ব্যবস্থা করা ও আইনি দিক গুলি প্রয়োগ করা। যানবাহন যে উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে, অবশ্যই সে উদ্দেশ্য পূরণের উপযুক্ত হতে হবে এবং যে কাজে ব্যবহৃত হবে সে কাজের জন্য আবশ্যকীয় নির্দিষ্ট যোগ্যতা ও যানটি ত্রুটিমুক্ত থাকতে হবে। সকল টায়ারের ন্যূনতম ২.০ মিমি টেড্র ডেপথ্ থাকতে হবে যাতে করে ব্রেক করলে রাস্তার সাথে প্রচুর ও প্রয়োজনীয় গ্রীপ করে। এছাড়া মানসম্পন্ন ওয়ার্কশপে ৬ মাস পর পর ন্যূনতম একবার ব্রেকিং এফিসিয়েন্সি এবং স্টিয়ারিং সিস্টেমের দক্ষতা ও কার্যকারিতা পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কোন যানবাহনের জন্য আরোহীর সংখ্যা, সিট সংখ্যা এবং লোড ডিজাইন ক্যাপাসিটি আইনী শর্তাবলী অবশ্যই পালন করতে হবে। সকল গাড়ি চালককে অবশ্যই যে ধরনের যানবাহন তারা চালাচ্ছেন, তার সঠিক লাইসেন্সের অধিকারী হতে হবে এবং যান চালনাকালীন সময়ে পরিপূর্ণ সুস্থ থাকা অনিবার্য। সকল ড্রাইভারকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে অনধিক ১২ ঘন্টা ড্রাইভিং (একটানা ৫ ঘন্টার অধিক ড্রাইভিং না করা)। কর্মঘন্টা এবং বিশ্রামের সময় বিষয় গুলো তাদের মালিক কর্তৃক নিশ্চিত করতে হবে যাতে তারা ক্লান্তি জনিত কারনে দুর্ঘটনায় না পড়ে।
যানবাহন চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার না করা। ড্রাইভারদেরকে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান হতে “রক্ষণাত্মক” গাড়ি চালনা’র বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া, যাতে তারা যানবাহন দুর্ঘটনা এড়ানোর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সক্ষমতা অর্জন করতে পারেন। রক্ষণাত্মক গাড়িচালনা হলো একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনা যেতে পারে। এই প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত দিক গুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো :
• পর্যবেক্ষণ – রাস্তায় চলাচলকারী অন্যান্য যানবাহনের এবং পদব্রজে চলাচলকারীদের প্রতি খেয়াল রাখা – অর্থাৎ রাস্তার পারিপার্শ্বিকতা পর্যবেক্ষণ করা।
• কোন ঘটনা সম্বন্ধে আগাম ধারণা করা- যেমন, রাস্তায় চলাচলকারী অন্যান্য যানবাহন চালকদের অথবা পথচারীদের গতিবিধি- সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সম্বন্ধে আগাম ধারণা করার ফলে সেই অনুযায়ী পরিস্থিতির সাথে খাপখাইয়ে গাড়ি চালনার মাধ্যমে দুর্ঘটনা এড়ানোর চেষ্টা করা।
• পরিকল্পনা করা- রাস্তা ও আবহাওয়ার অবস্থার কথা বিবেচনা করে নির্ধারিত গতিতে গাড়ি চালনার লক্ষ্য স্থির করা।
• পথচারী ও অন্যান্য চালকগণের প্রতি সংযম প্রদর্শন করা- চলন্ত কোন যানবাহনই দুর্ঘটনার কবলে পড়ার সম্ভাবনা হতে মুক্ত নয় এই ধারণাটি সর্বদা মনে রেখে গাড়ি চালানো।
• লেইন ডিসিপ্লিন মেনে চলা। অন্যকে বাধা না দেওয়া। আগে যাওয়ার জন্য হঠাৎ হঠাৎ গতি বাড়ানো কিংবা ঘন ঘন ব্রেক করা থেকে বিরত থাকা।
দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের দেশের চালকগণ পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নয়। আমরা সড়ক নিরাপত্তার সুপরিচিত এবং স্বল্প পরিচিত ৫টি বিষয় যেমন- প্রকৌশল (রাস্তার ডিজাইন, মেরামত, রাস্তার বাঁক গুলি যতটুকু সম্ভব কমানো ইত্যাদি), শিক্ষা (চালকদের. উন্নতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা), প্রয়োগ (আইনের সঠিক প্রয়োগ করা), মূল্যায়ন (যানকে ত্রুটিমুক্ত রাখা) এবং ব্যবস্থাপনা (চালককে অতিরিক্ত ডিউটি না দেয়া, সুস্থ অবস্থায় ডিউটি দেয়া, শুধুমাত্র চালকের উপর দায়িত্ব না দিয়ে যাত্রীগন নিরাপদে গন্তব্যে পৌছিয়েছে কিনা মালিক সেটিও খবর রাখবেন) তবেই আমরা সড়ক নিরাপত্তার প্রভূত উন্নতি করতে সক্ষম হব।
মো: গোলাম রববানী
ট্রান্সপোর্ট সেইফটি ম্যানেজার, প্রাইভেট কোম্পানী