লেখকের কথা
এটা আমার লেখা প্রথম গল্প। প্রায় দুইমাস ধরেই লিখছি। গল্পটির অধিকাংশ আমি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে লিখেছি। তখন আমার মা আমার পাশে বসে বলতেন, “এত কি লিখিস বাবা? তুই ঘুমা দেখি, আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেই?” আমার মা প্রথমদিন অসুস্থ আমাকে দেখে ভয়ানক ভাবে কেঁদে দিয়েছিলেন। আমি পাঠকদের গল্পটা পড়তে বলবোনা। আমি বলব আপনারা গল্পটাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করুন। আমাদের চারপাশের ভালোবাসাগুলো নিজের মাঝে ধারন করুন।
উৎসর্গ
প্রানপ্রিয় মা ও আমার সংগ্রামী বাবার উদ্দেশ্যে।
ক্লাস শেষে বের হয়েই ইভার সামনে পড়ে গেলাম। পাশ কেটে চলে যেতেই সে পিছন থেকে বলে, “আপনি আমাকে এড়িয়ে চলেন কেন? আমি কি আপনাকে খুব বিরক্ত করি?” মেয়েটি হয়তো কিছু সহানুভূতি আশা করেছিল। কিন্তু আমি গুড়েবালি দিলাম। কিছু না বলে শুধু মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দিয়ে চলে আসি। সে আহত দৃষ্টি নিয়ে মায়ামায়া চোখে তাকিয়ে থাকে। আমি মাঝেমাঝে অবাক হয়ে যাই এই মেয়েটা এত ধৈর্য পায় কোথায়। ইভা মেয়েটা আজকাল আসলেই খুব বিরক্ত করছে। মেয়েটার সাথে আমার পরিচয়ের গল্পটা খুব জটিল। সে আমার ছাত্রের খালাতো বড়বোন। যদিও সেই ছাত্রকে এখন আমি আর পড়াইনা। কিন্তু একই ভার্সিটিতে পড়ার কারণে তার সাথে পরিচয়টা হয়েই গেছে। ইদানিং অজানা কোনো এক কারণে মেয়েটা আমাকে খুব পছন্দ করতে শুরু করেছে। এর পিছনে কি কারণ থাকতে পারে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা। আমি বরাবরের মতোই ভবঘুরে একজন মানুষ। নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত। স্বাভাবিক হবার যে চেষ্টা করিনি এমনটা নয়। আমি আসলে পারিনা। আজ ইভার সাথে এমন ব্যবহারে নিজেও পরে অনুতপ্ত হয়েছি। তবুও আমার কিছু করার নেই।
২০০৩ সালের জুলাইয়ের একটি রোদেলা দিনে নিরা নামক একটি মেয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমি তখন ইন্টার প্রথম বর্ষের ছাত্র। মেয়েটিও আমার ক্লাসেই পড়ত। তার টোলপড়া হাসি আমি প্রতিদিন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। টিফিন টাইমে প্রতিদিন তিন টাকা দামী একটা বনরুটি যোগানোর সাধ্য আমার ছিলোনা। ঐ সময়টাতে নিরা যখন তার বান্ধবীদের সাথে হাসা-হাসি করতো আমি খুব আগ্রহ নিয়ে সেই সময়টার জন্য অপেক্ষা করতাম। তার হাসি দেখলেই আমার ক্ষুধার্থ ভিতরটা প্রশান্ত হয়ে যেত। একদিন খুব সাহস নিয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, কেমন আছেন? উত্তরে সে চোখদুটো চিকন করে বলেছিলো,” তুমি দেখছি কথাও বলতে পারো! আমি তো ভেবেছিলাম তুমি শুধু লুকিয়ে দেখতেই পারদর্শী। তুমি যে প্রতিদিন লুকিয়ে আমাকে দেখো সেটা কি আমি বুঝিনা ভেবেছো?” আমি মাথা নিচু করে তাকে সরি বলি। সে আমার কানে চিমটি কেটে বলে, “আজ থেকে আমরা বন্ধু, কেমন!” আমি সেদিন খুব খুশী হয়ে আমার সাতদিনের বনরুটির টাকা পথশিশুদের দান করে দিয়েছিলাম। আমরা প্রতিদিন ক্লাসের পর একসাথে হাঁটতাম। প্রায় দিন আমরা একসাথে টাউনহলে প্রোগ্রাম দেখতাম। বন্ধুত্বের একটি পর্যায়ে আমি ছোট্ট একটি চিরকুটে নিজের ভালোবাসার কথাগুলো তাকে জানাই। সে খুব আনন্দের সাথে সম্মতি জানায়। তারপর থেকেই আমাদের ভালোবাসার গল্পটা শুরু হয়।
নিরার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল একটি মেঘলা বিকেলে। আমি প্রতিদিনের মতোই পঁচিশ মিনিট দেরি করে প্রিয় পার্কটিতেই পৌঁছেছিলাম। নিরা সেদিন সম্পর্কের এক বছর, তিনমাস তেইশ দিনের মাথায় আমাকে বলে, “শামীম, মনেহয় আমার আর তোমাকে ভালো লাগছেনা।” আমি হাসতে হাসতে বলি,” কেন? আমার কি দুটোর বদলে তিনটি কান হয়ে গেছে? খুব পচা লাগছে দেখতে? তুমি চাইলে একটা কান কেটে দিতে পারো। তাহলে ভালো লাগবে?” আমার কথা শুনে রাগে নিরার নাকটি লাল হয়ে যায়। আমি অবাক হয়ে তাকে দেখি, আর ভাবি সৃষ্টিকর্তা এই মেয়েটার মাঝে এত মায়া কিভাবে দিয়েছে! তখন আমার ভাড়া বাঁচিয়ে হেঁটে আসা ক্লান্ত শরীর তার কোমল মুখের শুভ্রতার মতোই প্রফুল্লতায় ভরে ওঠে। আমি ঘোরের মাঝেই আলতো করে তার কোমল নাকটি ছুঁয়ে দেই। প্রিয় নিরা, তুমি রাগ করলে আজও কি তোমার নাকটি লাল হয়ে যায়? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে আজও কি গভীর ভালোবাসা নিয়ে কেউ তোমার নাকটি ছুঁয়ে দেয়? সেদিন আমার ছোঁয়াতে তুমি যেভাবে আরও রেগে গিয়ে থাপ্পড় দিয়েছিলে সেরকমটা আর কাউকে দাওনা তো! প্রিয় পাঠক, সেদিন নিরা আমার ভালোবাসাকে অনুভব করতে পারেনি। তার কোমল হাতের থাপ্পড় খাওয়ার পরও আমি যখন তার দিকে তাকিয়ে হাসিহাসি মুখে বলি, “শোনো মেয়ে আমি একটুও মন খারাপ করিনি, কেমন। তুমি যেদিন প্রথম রংধনু হয়ে আমার আকাশে এসেছিলে, ঠিক সেদিনই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোমার রাগ, ঘৃনা কিংবা ভালোবাসার একমাত্র অংশীদার শুধু আমিই হবো।” নিরা তখন বিভ্রান্ত হয়। আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “আচ্ছা শামীম তোমার লজ্জা করেনা? আমার অবহেলা তোমার ব্যক্তিত্বকে আঘাত করেনা? তুমি কি কিছুই বোঝনা?”
রাত বারোটা সতেরো মিনিটে ইভা আমাকে কল করে বলে, “আগামীকাল আপনার একটু সময় হবে? একটু দেখা করতে পারবেন?” আমার ভালো লাগেনা ইভার এই বিষয়টা। তাই আমি আর কথা না বাড়িয়ে বলি, “আপনি কখনো কাগজের ফুল দেখেছেন? বাহির থেকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগলেও ভিতরে কোনো সুগন্ধ নেই। আমাকে কাগজের ফুল ভাবতে পারেন।” আমার কথা শুনে ইভা অর্ধমিনিট চুপ করে থেকে বলে “আমি না হয় কাগজের ফুল দিয়েই নিজেকে সাজালাম! সুগন্ধি ফুল কিন্তু বিষাক্তও হতে পারে। “আমি বলি ইভা জীবনের রঙ্গমঞ্চে আমরা সবাই অভিনেতা। সুখে থাকার অভিনয়ে মিছে মিছি জয়ী হবার অপচেষ্টা কেন করছেন? আপনি ভালো থাকুন। সত্যিকারের ফুল দিয়েই জীবনটাকে সাজিয়ে নিন।”
সেদিন সন্ধায় রিফাত কোথা থেকে এসে আমাকে বলে, “দোস্ত ছোটবেলায় আম্মায় যখন অন্যের বাড়িতে কাজ কইরা ক্লান্ত হইয়া বাসায় ফিরতো, আমি আম্মার ব্যথাধরা পায়ে তেল মালিশ করতাম আর বলতাম, আম্মা আপনারে আর কোথাও কাম করতে দিমুনা। কাইলকা থিকা আমি স্কুল ছাইড়া কামে যামু। আমার আম্মা তখন হাইসা আমার কপালে একটা চুমু দিয়া কইতো, বাজান তুমি যেদিন পড়ালেহা কইরা বড় বড় চাকরি করবা হেইদিন আমার পায়ের ব্যথার কষ্ট সার্থক হইবো। আইজকা আমি যে কষ্ট পাইতাছি হেইদিন হের চেয়ে বেশি সুখ পামু। ছোটবেলায় একবার আমার নিউমোনিয়া হইছিলো দোস্ত। আমি ঠান্ডায় কাঁইপা কাঁইপা উঠতাম বলে আমার আম্মা বাসার সব কাপড় আমার গায়ে দিয়ে নিজে ঠকঠক করে কাঁপতো। দোস্ত আম্মার দুই পাশের কিডনিই প্রায় নষ্ট হইয়া গেছে। সরকারি হসপিটালের কেবিন ভাড়া দিতে পারি নাই। মেঝেতে বিছানা কইরা আম্মারে রাইখা আসলাম। আম্মা পেটের ব্যথায় চিৎকার কইরা বলে, খুব কষ্ট হয় বাজান, নাড়িটা আমার ছিঁইড়া যায়। আমি সন্তান হয়ে আমার জনম দুখিনী মায়ের জন্য কিচ্ছু করতে পারলামনা দোস্ত। এই দুঃখ আমি কই রাখি বল? “আমি রিফাতকে জড়িয়ে ধরে বলি, “আমার আম্মায় দেখতে কেমন ছিল বলতে পারিনা দোস্ত। কিচ্ছু মনে নাই। এক মায়েরে পাইছি, তারে আর হারাইতে চাইনা। গাবতলি থেকে মতিঝিল সব বাসে উইঠা টাকা তুলমু। টেনশন নিসনা আম্মা ঠিক হইবো, আমরা আবার আম্মার হাতের পায়েস খাব।”
পরদিন ইভার সাথে আমার সমাজকল্যান ভবনের সামনে দেখা হয়। জাহাঙ্গীরনগরের সবুজেঘেরা ক্যাম্পাসে হাঁটতে হাঁটতে সে আমাকে বলে, “আপনার জীবনের গল্পটা বলবেন? আমার না খুব ইচ্ছা চাঁদের আলোয় ডুব মেরে আপনার গল্প শোনার। আপনি কি শোনাবেন?” আমি চুপ করে থাকি। সে আবারও বলে, “আপনি কিন্তু এখন পালাই পালাই ভাব করবেন না আশা করি।”
আমি তার দিকে তাকিয়ে বলি, শুনুন ইভা, আজ থেকে তিনবছর আগে আমি কারো হাত ধরে বলেছিলাম, “তুমি কি আমার রাতজাগার সঙ্গী হবে?” সে খুব মায়াবী একটা হাসি দিয়ে বলেছিলো, “হবো”। আমি সেদিন থেকেই আমার আকাশে তাকে রংধনু ভাবতাম। ইভা আজ সে ঠিকই কারো রাতজাগার সঙ্গী, তবে আমার নয়। আমার সাথে যেদিন সম্পর্কের ইতি টানে তার ঠিক তেত্রিশ দিন আগে জাহিদের সাথে তার পরিচয় হয়। এরপর কয়েকদিন তাকে জাহিদের বাইকের পিছনে দেখি। তবুও আমি তাকেই ভালোবাসতাম। তার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ ছিলোনা। এতকিছুর পরেও যেদিন সে আমাকে বলে, “আচ্ছা শামীম তোমার লজ্জা করেনা? আমার অবহেলা তোমার ব্যক্তিত্বকে আঘাত করেনা? তুমি কি কিছুই বোঝনা? “আমি সেদিন আর সহ্য করতে পারিনি। আমি তাকে বলি, “নিরা আমি সবই বুঝি। শুধু যে মুখ থেকে প্রতিটি শব্দ আমাকে ভালোবেসে উচ্চারিত হতো সেই মুখ থেকে শোনার অপেক্ষায় ছিলাম। তুমি জানোই আমার এতদুর আসার পিছনে কত সংগ্রাম লুকিয়ে আছে। জাহিদ অনেক সুদর্শন এবং টাকাওয়ালা। জাহিদের মতো আমার দামী বাইকও নেই। তোমার তার প্রতি দূর্বলতা থাকতেই পারে। এজন্য আমি তোমাকে দোষ দেইনা, তবে তুমি আমার ভালোবাসাকে মূল্যায়ন না করে অনেক বড় ভুল করলে। তোমার যদি আমাকে ভালো নাই লাগবে তাহলে কেন আমার সাথে এতদিনের ভালোবাসার অভিনয়? “নিরা সেদিন মাথা নিচু করে বলে, “আমি সরি। তুমি ভালো থেকো। “সেদিন আমি একটুও কাঁদিনি ইভা। শুধু নিজেকে একখন্ড পাথরে রূপ দিয়েছি। আমি নিজের শুকিয়ে যাওয়া অনুভূতিগুলোকে সম্বল করে শুধু বলি, “ভালোবাসা যখন উপেক্ষার আবরণে আবৃত হয় তখন সেখানে প্রাঞ্জলতা থাকেনা নিরা। তখন তা হয়ে পড়ে একরাশ সস্তা অনুভূতির সমষ্টিমাত্র। এই সস্তা ভালোবাসা আমার কাম্য নয় নিরা। তুমি বরং তোমার মতোই থেকো।”
“ইভা, একটি গাছ যখন একবার গোড়ায় ভেঙ্গে যায় তারপর তা আর কখোনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা। একবার সাজানো স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে গেলে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে চাইলেও বুকটা কেঁপে ওঠে। তবুও কেন আপনার এই চেষ্টা? কেনো আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে বারবার দ্বিধায় ফেলছেন? আমার আকাশে আর রংধনু ওঠেনা। কিংবা উঠুক সেটা আমি চাইওনা। আপনি খুব সুন্দর করে ভালোবাসার কথাগুলো বলতে পারেন। আমাকে এভাবে ভালোবাসবেন না, এরকম করে ভালোবাসাটা মানুষের ভিতরটাকে দখল করে নেয়। আমি চাইনা আপনি আপনার সবকিছু দিয়ে আমাকে ভালোবেসে নিজে নিঃস্ব হোন। হতে পারে আমাকে পাওয়ার পর একসময় আপনি নিজেই আমার উপর আসক্তি হারিয়ে ফেলবেন। তখন সম্পর্কটা নিতান্তই অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে। প্রতি মুহূর্তে কিছু একটা অপ্রাপ্তির বিষাদ ধেয়ে বেরাবে আপনাকে। তখন কেমন হবে বিষয়টা বলুনতো? আসলে ইভা আমাদের কোনোকিছুর প্রতি ততক্ষন আগ্রহ থাকে যতক্ষন সেটা আমাদের স্পর্শের অন্তরালে থাকে। কাছে পাওয়া জিনিসগুলো সবসময়ই অবহেলিত। আপনার মাঝে যেটা কাজ করছে সেটা আমার প্রতি সহানুভূতি কিংবা মোহ হতে পারে এটাকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করবেন না। ভালোবাসাগুলোকে হৃদয়ে ধারন করার চেষ্টা করুন। কথাগুলো এভাবে বলার জন্য আমি সরি, কিন্তু এছাড়া আমার কিছু করার ছিলোনা।”
কথাগুলো বলার পর আমার মনে হলো বড় কোনো ভুল হয়ে গেছে। আমার এভাবে বলা উচিত হয়নি। এই প্রথম ইভা চোখে অশ্রু নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনি মনেহয় নিরাকে খুব বেশি ভালোবাসতেন তাইনা? তার জন্য আপনি আমার ভালোবাসাকেও বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমিও আসলেই দুঃখিত। আমিও আপনার আকাশের রংধনু হতে চেয়েছিলাম। আমি বুঝতেও পারিনি এতটা পাবার যোগ্যতা আমার নেই। আপনাকে আর কখোনোই বিরক্ত করবনা। ভালো থাকবেন কেমন। তবে আপনাকে একটা কথা বলি, আমার অনুভূতিগুলো মোহ ছিলনা। আপনি যখন নিরা আপুর সাথে রিক্সায় ঘুরতেন, আমি তখনও ভাবতাম আপনাদের সম্পর্কটা ক্ষনস্থায়ী। আমি ভাবতাম আপনি একমাত্র আমার সাথেই ঘোরার ক্ষমতা রাখেন, এবং একদিন আপনি আমারই হবেন। আমার এতদিনের জমানো স্বপ্ন মোহ হতে পারেনা।” কথাগুলো বলেই সে দৌড়ে চলে যায়। আমার অনেক কষ্ট হয়। আমি নিজের সাথে অনেক বোঝাপড়া করেও কোনো সমাধানে যেতে পারিনা। মনে মনে বলি, “ভালো থেকো ইভা, আমাদের মতো চালচুলোহীন অভাবী মানুষদের জন্য ভালোবাসা নয়। নিরা আমাকে সেটা নির্মমভাবে শিখিয়ে দিয়েছে।”
দেখতে দেখতে দিন কেটে যায়। আমার গ্রাজুয়েশন শেষের পথে। আজকাল নিজেরই নিজেকে বিরক্ত লাগে। রিফাতের মা কে অনেক চেষ্টায়ও আর বাঁচানো যায়নি, মায়ের হাতের পায়েসও আর খাওয়া হয়নি। টাকার অভাবে একজন মা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। যে মা সন্তানকে পড়ানোর জন্য আজীবন দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করেছেন সেই মা। আমাদের সমাজে দশটাকার সিগারেট না খেয়ে তা দান করে একজন অসুস্থ মা কে বাঁচাতে এগিয়ে আসার মতো উদার মনের বড্ড অভাব। এই শহরের প্রতিটা প্রানী নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। ক্ষয়ে যাওয়া এই ফুটপাতে মানবতার খুবই অভাব। রিফাত এরপর থেকেই মাঝে মাঝে পাগলের মতো করে। গভীর রাতে আমার দরজায় নক করে। আমি দরজা খুললেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মা ঘুমুতে দেয়না দোস্ত। ঘুমের মাঝে আমাকে ডেকে বলে, খুব কষ্ট হয় বাজান, আমার নাড়িটা ছিঁইড়া যায়।” আমি রিফাতকে রুমে নিয়ে আসি, ওকে চিড়া আর গুড় খেতে দেই। সে খেয়ে ঢেকুর তুলে আমার বিছানাতেই ঘুমিয়ে যায়। আর আমি গভীর রাতে ফুটপাতে নেমে পড়ি। সোডিয়ামের আলোতে জীবনের অবয়ব খুঁজি। আমার বাবা যখন খাদ্যনালীতে ক্যান্সার হয়ে চিকিৎসার অভাবে মারা যান তখন আমার বয়স মাত্র চার বছর সাতমাস। আমার বোকাসোকা বাবাটাকে যেদিন আমি প্রথম “বাবা” বলে ডেকেছিলাম সেদিন নাকি তিনি খুশিতে সারা গ্রাম আমাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন আর সবাইকে আমার “বাবা” ডাকার কথা গর্বের সাথে ব্যাখ্যা করেছিলেন। এ কথা আমি অবশ্য আমার মায়ের থেকে শুনিনি। কারন বাবা মারা যাওয়ার প্রায় একবছর পরে তিনিও আমাকে ছেড়ে বাবার কাছে চলে যান। হয়তো ভালোবাসার মানুষটিকে হারানোর আঘাতটা সহ্য করতে পারেননি। তাই মায়ের বিরুদ্ধে আমার অনেক অভিযোগ। কেন তিনি আমাকে একা রেখে চলে গেলেন! আমাকে সাথে নিলে কি খুব ক্ষতি হতো? আমার দুই দুইজন ভালোবাসার মানুষ আমাকে একা করে চলে যাওয়ার পর আমি কিভাবে বেঁচে ছিলাম আমি নিজেও জানিনা। বাবাকে হারানোর পর আমি প্রায়ই যখন ঘুমের মাঝে বাবা বাবা বলে চিৎকার করতাম, আমার মমতাময়ী মা আমার কপালে আদর করে দিয়ে বলতো, “কাঁদেনা বাবু। খুব তাড়াতাড়ি আমরা তোমার বাবার সাথে দেখা করতে যাবো,কেমন।” এরপর থেকে আমার মা সবসময় চুপচাপ থাকতেন। ঠিকমতো খেতেন না, নিজের যত্ন নিতেন না, কিছু বললে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। কিন্তু তিনি আমাকে খুব আদর করতেন, অনেক স্নেহ করতেন। একদিন খুব সকালে মা আমাকে ডেকে বলেন, “তোর বাবার একা একা অনেক কষ্ট হয় বাবু। আমি যাই? তুই অনেক বড় হবি কেমন। দুনিয়াকে কখোনোই ভয় পাবিনা।” আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বলি “আমিও যাবো মা তোমার সাথে। কত্তদিন বাবার কাঁধে উঠিনা!” সেদিনের সেই ছোট্ট আমি বুঝতেও পারিনি আমার স্নেহময়ী মা আমাকে একা রেখে কোথায় যাচ্ছেন। এর ঠিক তিনদিন পর আমার মা হার্ট এটাক করে বাবার কাছে চলে যান। জীবনের প্রথম দিকের এই ধাক্কাটা আমাকে একদম নিশ্চুপ করে দেয়। প্রায় রাতেই স্বপ্নে বাবা আর মা আমার শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আমার খুব কষ্ট হয়, আমি আমার বাবা-মায়ের ভালোবাসাগুলো অনুভব করতে পারি কিন্তু আমি তাদের দেখতে পারিনা। আমার বাবার নাকি খুব ইচ্ছা ছিলো আমাকে অনেক বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি ডিপার্টমেন্টে আমি যেদিন ভর্তির সুযোগ পাই সেদিন আমার বাবাকে খুব মনে পড়েছিল। মাকে হারানোর পরের দশবছর আমি আমার দূর সর্ম্পের চাচার বাড়িতে বড় হই। কোনো কাজ করতে দেরি হলে আমার চাচা আমাকে যখন ধরে ধরে মারতেন আমি তখন শুধু আমার বাবা-মায়ের কথা ভেবে বাঁচতাম। তারা স্বপ্ন পূরণের যে প্রতিজ্ঞাটা আমাকে করিয়ে ছিলেন তা আমি এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারিনি। আমার বাবা আমার কাছে একটা সমুদ্রের মতো যার অস্তিত্বের কোনো পরিসীমা নেই। আর মা একখন্ড চাঁদের মতো, যিনি গভীর অন্ধকারে আমার পথ আলোকিত করেন। আমার যখন খুব বেশি কষ্ট হত আমি তখন প্রিয় করতোয়া নদীতে পা ডুবিয়ে বসে থাকতাম। আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে সবুজ ঘাসের উপর বসে কিংবা করতোয়ার বুকে ডুব দিয়ে।
আমার মাঝে মাঝে ইভাকেও মনে পড়ে। আচ্ছা পাঠক বলুনতো, ইভার হাতটা ধরে জীবনের অর্থ নতুন করে খোঁজার চেষ্টা করলে কেমন হয়? সোমবার বিকেল চারটায় হাতে একটা কাগজ নিয়ে রিফাত দৌড়ে আমার রুমে আসে। আমি দরজা খুলে বলি, “কাল সারারাত পেটের ব্যথায় ঠিকমতো ঘুমুতে পারি নাই, তুই যদি এখন বিরক্ত করিস তাহলে তোর পশ্চাতদেশে চটাশ করে একটা থাপ্পড় দিব।” আমার কথা শুনে রিফাতকে কোনো রকম বিচলিত হতে দেখা গেলোনা। সে আমাকে ধাক্কা মেরে রুমে ঢুকে বলল, কানাডার স্কলারশিপের রেজাল্ট দিছে জানিস? আমি বললাম, “নাহ তো! তোর হইসে?” সে হাতের কাগজটা আমাকে দিয়ে বলে, ” আমার না, তোর হইছে। আইজকা আর চিড়াগুড় খামুনা মামা।” কাগজটি দেখে আমি আসলেই অবাক হই। আমার স্কলারশিপ পাওয়ার কথা ছিলোনা। অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে আমার থিসিসের বিষয়টাও ছিলো সাধারন। আমি আসলে এতটা আশা করিনি।
পরদিন ক্যাফেটেরিয়ার সামনে ইভার সাথে দেখা হয়েই গেল। আমি তাকে বললাম, আপনার আপত্তি না থাকলে আমরা কি একসাথে কফি খেতে পারি? সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আমি কফি খেতে খেতে ভাবি তাকে কি আমার কিছু বলা উচিত? আমাকে সুযোগ না দিয়ে ইভা নিজেই বলে ফেললো, আপনি কি কিছু বলবেন? আমি একটু দম নিয়ে কাচুমাচু করে বলি, “আচ্ছা ইভা আমার কি কাউকে ভালোবাসা উচিত নয়? ভালো থাকার অধিকার কি আমার নেই? জীবনের অনেকটা পথই তো পেরিয়ে এলাম। আজও আমার প্রাপ্তির খাতাটা শুন্য। হাজারো ব্যর্থতার সমীকরণ মেলানো শেষে আজ আমি ক্লান্ত। আচ্ছা আমার আকাশের নিকষ কালো আধারের সাথে তোমার ভোরের একটুকরো আবির মিশিয়ে একটি প্রেমময় গোধুলির সৃষ্টি করলে কি খুব বাজে হবে? তুমিই না হয় আমার প্রাপ্তি হয়ো! আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমাকেই আমার রংধনু বানাবো। আমাকে বিয়ে করবে? আমি দুঃখিত আপনাকে তুমি করে বলার জন্য। “আমি কথাগুলো এক নি:শ্বাসে কিভাবে বলে ফেললাম তা আমি নিজেও জানিনা। আমি ভাবতেও পারিনি এমন একটা সিদ্ধান্ত আমি এত তাড়াতাড়ি নিয়ে ফেলবো। আমি ইভার উত্তরের অপেক্ষায় থাকি। ইভা তার বা হাতের অনামিকা আক্সগুলটা দেখিয়ে হেসে বলে, “আমি দুঃখিত শামীম। আমার হাতের আংটিটা দেখতে পাচ্ছেন? এটা আমাকে তেরোদিন আগে বরপক্ষ পরিয়ে গেছে। ছেলের নাম আরমান লাবিব। অস্ট্রেলিয়ায় থাকে, মস্তবড় বিজনেসম্যান। আমার আন্ডারগ্রাজুয়েশন আগামি বছর শেষ হলেই আমাদের বিয়ে। তারপরেই আমিও অস্ট্রেলিয়ায় উড়াল দিবো। এখন আমার কিছুই করার নেই। আর আমি এও জানি আপনার কাছে নিরার স্থানটি আমি কখোনোই পাবোনা। আমি কিসের আশায় থাকবো বলতে পারেন? “আমি ইভার দিকে তাকিয়ে থাকি। কি বলবো খুঁজে পাইনা। কিছুক্ষন সময় নিয়ে বলি, “আমি দুঃখিত তোমাকে এরকম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার জন্য। তোমার মোহ কেটে গেছে। আসলেই এখন তোমার মুভ অন করা উচিত। খুব সম্ভবত আমাদের আর বেশিদিন দেখা হবেনা। তোমার জন্য শুভকামনা রইল।” আমি যখন ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হই তখন আমার মাথায় একটাই প্রশ্ন, ইভা কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসতো? তাকে বলা হয়নি যে ভালোবাসায় প্রতিদানের কোনো স্থান নেই। যে সত্যিকারের ভালোবাসতে জানে সে বিনিময়ে কিছু আশা করেনা। কারন সে জানে তার ভালোবাসাই আমাকে তাকে ভালোবাসতে বাধ্য করবে।
সেদিন সন্ধার আগেই আমি আমার প্রিয় গ্রামটিতে চলে যাই। আমার বাবা-মায়ের কবরের পাশে বসে অনেক অভিযোগ জানাই যার সবই নিজের প্রতি। তাদের থেকে দোয়া নিই ভিনদেশে যাওয়ার জন্য। কানাডা যাওয়ার সব ফর্মালিটিজ শেষ করতে আমার পরের একমাস খুব ব্যস্ততার সাথে কেটে যায়। কিছু টাকারও প্রয়োজন ছিল যার সমাধান বন্ধুদের মাধ্যমে হয়ে যায়। যেদিন আমার ফ্লাইট, রিফাত আমার হাত ধরে কেঁদে বলে, “তুই আমার বন্ধু না, তুই ছিলি আমার ভাই। যত দুরেই থাকিস ভুলে যাসনে ভাই।” আমি ওর পিঠ চাপড়ে বলি, “আজ থেকে পাঁচবছর আগে একজন অনেক বড় একটা আঘাত দিছিল, তাকে আজও ভুলিনাই। আর তুইতো আমার ভাই। ভাবিসনা শীঘ্রই আবার ফিরে আসবো, হতে পারে এই দেশের মানুষগুলো আমার সাথে অনেক প্রতারণা করেছে কিন্তু আমার জন্মদাতা বাবা এবং জন্মদাত্রী মা এই মাটিতে শুয়ে আছে। আমার তো আসতেই হবে।”
এই সাদা চামড়ার দেশে আমি বারোটি বছর কাটাই। পিএইচডি শেষে আমাকে সেই ইউনিভার্সিটিতেই লেকচারার হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। আমার কোনো পিছুটান ছিলোনা। মাঝে মাঝে রিফাতের সাথে কথা হত শুধু। ভিনদেশে থাকতে তাই খুব একটা মন্দ লাগছিলনা। শুধু ব্যস্ততামুক্ত গভীর রাতগুলোতে নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম। মাঝে মাঝেই করতোয়ার পাড় ধরে হেঁটে যেতাম বহুদুর। পরের বছর যখন আমাকে পার্মানেন্টলি রিসার্চার্স টিম এ জয়েন করার সুযোগ দেওয়া হয় তখন আমি স্যারকে বলি, “সরি স্যার, আমি আমার দেশে ব্যাক করতে চাই।” স্যার হেসে বলেন, “এশিয়ান ইয়াংম্যান, কানাডার ঝকঝকে আবহাওয়া সহ্য করতে পারলেনাতো!” আমি স্যারকে বলি, “এইদেশের ইটপাথর আর ভালো লাগছেনা স্যার। আমার এখন আমার ছোট্ট দেশটাতে সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে ঘাসফড়িং এর সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করছে।” স্যার চোখে পানি নিয়ে আমাকে বলেন, “আমি তোমার দেশপ্রেমকে সম্মান করি শামীম। আসলে আমিও বহুদিন থেকে আমার দেশের মাটির গন্ধ নেইনি। তোমার কথা শুনে ভাবছি আমিও এবার দেশে গিয়ে নিজের আত্মাটাকে পবিত্র করব।”
আমি বারোবছর চারমাশ সতেরোদিন পর যেদিন দেশের মাটিতে পা রাখি সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। খুব ইচ্ছে করছিল বন্ধুদের সাথে ছোটবেলার মতো জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতে। রিফাত নিজে গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে এসে আমাকে রিসিভ করে। আমাকে দেখে সে একগাল হেসে বলে, “শেষমেশ গাড়িটা কিনেই ফেললাম দোস্ত। আমি মাঝে মাঝে কল্পনায় আমার আম্মাকে গাড়িতে নিয়ে ঢাকা শহর ঘুরাই। তুই এখন আমার বাসায় যাবি। তোর ভাবী ঠিক আম্মার মতোই পায়েস বানায়। দুজনে একসাথে খাব চল। “আমি রিফাতকে বাধা দিয়ে বলি, “আমার সব ভালোবাসা সেই করতোয়া নদীর তীরে জমা হয়ে আছে দোস্ত। আমি সেগুলোকে গভীর থেকে অনুভব করতে চাই।” আমরা যখন আমার ছোট্ট গ্রামে পৌঁছাই তখন দুপুর দুইটা তিরিশ মিনিট। এই সময়টাতে মা আমার মাথাটা কোলে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। আমি যেদিন চাচার বাসা থেকে পড়াশোনার জন্য শহরে পালিয়ে যাই, আমার পকেটে ছিল সাতচল্লিশ টাকা এবং একটা ছেঁড়া একশো টাকার নোট। আজ আমার কাছে অর্থের অভাব নেই। শুধু একমুঠো ভালোবাসার অভাব।
আমি আমার মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলি, প্রিয় মা, “তুমি যে ভালোবাসার চাদরে আমাকে সবসময় মুড়িয়ে রাখতে, তুমি চলে যাওয়ার পর এরকমটা আর কেউ করেনি। সম্পূর্ন মমতাহীন পরিবেশে বড় হয়েছি। মা গো দশমাশ পেটে ধরেছ, না জানি কতবার লাথি মেরেছি তোমার পেটে। তুমি চলে গেলে, তোমার জন্য কিছুই করতে পারলামনা। তোমার সীমাহীন ভালোবাসার একটুখানি আমার জন্য কেন রেখে গেলেনা বলোতো? “আমি আমার ঘুমিয়ে থাকা বাবাকে বলি, “তুমি যেদিন আমাদের ছেড়ে চলে যাও, সেদিনের সেই ছোট্ট আমি একটুও কাঁদিনি। শুধু ছোট্ট আমি ভাবছিলাম এখন থেকে আমাকে কাঁধে নিয়ে কে ঘুরবে! বাবা এই পৃথিবী আর আমার ভালো লাগেনা। আমার তোমার কাছে গিয়ে কাঁধে উঠতে ইচ্ছে করে। আমি কি আসবো?”
রিফাতের জোরাজুরিতে তার বাসাতেই আমার উঠতে হয়। আমার হাহাকারময় জীবনের পুরোটাই সে জানে। আমাকে বলে, “জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছিস একা একা। এবার তো একটা বিয়ে করে সংসারী হ?” আমি তার পিঠ চাপড়ে বলি, “ভালোবাসা জিনিসটা আমার হজম হয়না দোস্ত। আর ভালোবাসাই যেখানে নেই সেখানে বিয়ের সিদ্ধান্তটা নিতান্তই মূল্যহীন। এরপরও কি তুই আমাকে বাধ্য করতে চাস?” রিফাত আর কথা বাড়ায়না এই বিষয় নিয়ে।
আমি আমার মায়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বাকি জীবন দেশেই কাটাবার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। ঢাকায় ছোট্ট একটা এপার্টমেন্ট কিনে সেখানেই আমার নিবাস সাজাই। প্রিয় ইউনিভার্সিটিতেই লেকচারার হিসেবে যোগ দেই। আমার মাঝে মাঝে একদমই বাঁচতে ইচ্ছে করেনা। নিজেকে উদ্দেশ্যহীন মনে হয়।
নীলক্ষেতে একটা বইয়ের দোকানে একদিন ইভার সাথে দেখা হয়ে গেল। তার সাথে ছোট্ট একটি মেয়ে। অনেকটা ইভার মতোই দেখতে। আমি তাকে না চেনার ভান করে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতার বই কেনায় মনোযোগ দেই। ইভা আমাকে ডেকে বলে, “ভুলে গেছ? নাকি ভুলে যাওয়ার অভিনয় করছ?” আমি বলি, “অভিনয় জিনিসটা আমি নিঃসন্দেহে খুব ভালো পারি সেটা তুমি ভালো করেই জানো। নতুন করে বলবার কিছু নেই? এই পিচ্ছি আম্মুটা কি তোমার মেয়ে?” ইভা মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দিয়ে বলে, “আপনার আপত্তি না থাকলে আমরা কফিশপে বসি?” আমি পিচ্ছিটাকে আইসক্রিম কিনে দিয়ে বলি তোমার নাম কি মামনী? সে ফোকলা হাসি দিয়ে বলে “নিরা।” আমার ভিতরটা গুমরে ওঠে। কফিশপে বসে ইভা আমাকে বলে, আপনি এত ভালো ছাত্র ছিলেন জানতামনা। আপনি কানাডায় যাওয়ার পরে বুঝলাম। আপনি তো আমাকে মূল্যই দিতেননা। আমার মনে একটা পুরোনো প্রশ্ন জমে আছে বহুদিন থেকে। বলব?” আমি হেসে বলি, ” থাক। পুরোনো প্রশ্ন না করাই ভালো। অতীত যখন আমাদের বর্তমানের মাঝেও জীবন্ত হয়ে ওঠে তখন বর্তমানের কাম্য অনেক কিছুই নিরর্থক হয়ে দাঁড়ায়। যেটা আমি কখনোই চাইনা। তার চেয়ে বলো তুমি কেমন আছ? ঢাকায় কেন? তোমার তো অস্ট্রেলিয়ায় থাকার কথা।” ইভা ইতস্তত করে বলে, “বিয়ে করেছিলাম, সুখী হতে পারিনি। তাই দুজনের ইচ্ছেতেই জীবনকে দুজনের থেকে আলাদা করে নিয়েছি। লাবিব ভালোবাসতে জানতোনা জানেন। রোজ রাতেই মেয়ে বন্ধুদের সাথে পার্টি করে বাসায় ফিরতো। বিদেশে এই কলচারটা হয়তো খুব স্বাভাবিক। কিন্তু একজন নারী হিসেবে আমি এটা নিতে পারিনি।
তার ফলেই আলাদা হয়ে যাওয়া। আমি কি ভুল করেছি? আপনি কি আমাদের দেখা হওয়ার শেষ দিন সিরিয়াসলি আমাকে ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন? উত্তরটা আমার জন্য খুব দরকারি। “আমি ইভার চোখের দিকে তাকিয়ে বলি, “ইভা আজ আমি যাই বলি সব অর্থহীন। আজকের প্রশ্নটা তুমি তেরো বছর আগে করলে আমার জীবনের গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো। আসলে জানো তুমি যখন আমাকে তোমার ভালোবাসার অনুভূতিগুলো বলতে আমার খুব ইচ্ছে করতো তোমার অবাধ্য চুলগুলোকে তোমার কানে গুজে দিতে। আমার ভয় করতো ইভা। আমি চালচুলোহীন মানুষ ছিলাম। নিজের বলতে কিছুই ছিলোনা। তাই এত দামী তোমাকে চাওয়ার সাহস করে উঠতে পারতামনা। আমি ঠিক যেদিন স্কলারশিপ পাই তার পরেরদিনই তোমাকে নিজের অনুভূতিগুলো জানিয়েছি। কিন্তু ততক্ষনে হয়তো তোমার ক্ষণস্থায়ী ভালোবাসার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। আমার হৃদয়ে অনেক বড় একটা ক্ষত হয়েছিল তুমি জানতে, সেই ক্ষত না শুকাতেই তোমাকে চাইবার সাহস করেছিলাম ইভা। আমার সেটা উচিত হয়নি। তোমাকে পাওয়ার লোভ করে আমার হৃদয়ে যে নতুন ক্ষতটা হয়েছে সেটা আজ তেরো বছর পরেও আমাকে আর কাউকে চাওয়ার সাহস করতে দেয়নি। আজকের কথাগুলোতে কষ্ট পেওনা। আমি জানি তুমি আমার সবকিছু জেনেই পিছিয়ে গিয়েছিলে। নিরার মতো তোমারও এই অধিকার আছে। তাই আমার কথায় কষ্ট পেওনা। আমি তেরো বছর ধরে এই প্রশ্নটার উত্তর বয়ে বেড়াচ্ছি।” আমি কথা শেষ করে দেখি ইভা কাঁদছে। সে বলে,” শামীম আমার ক্ষনস্থায়ী আবেগের পরিসমাপ্তি সেদিন ঘটেনি। আমি অনেক দেরিতে বুঝেছিলাম বিষয়টা, লাবিবকে বিয়ে করার পর। আমি ভুল ছিলাম। এই ভুলটাই আমাকে শেষ করে দিলো। ওইযে দুরে বসে থাকা আমার মেয়েটাকে দেখুন, তার জন্য আমার কষ্ট হয় জানেন। আচ্ছা আপনি আজও আমাকে ভালোবাসেন তো তাইনা? আপনার কনটাক্ট নাম্বার টা পাওয়া যাবে?” আমি চুপ করে থাকি। এরপর আমাদের নাম্বার বিনিময় হয়। পরের দুইদিন ইভা আমার সাথে কথা বলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই। খুব কাছের মানুষের মতো।
আমি তিনদিন পর ইভাকে কল করে বলি, “আচ্ছা ইভা আমি নিরার বাবা হলে কি খুব মন্দ হবে?” ইভা ইতস্তত করে বলে, “করুনা করবেন না শামীম। আপনার ভালোবাসাটা আমার জন্য রাখবেন, বিয়ে করে করুনা নয়। তাছাড়া আমি আবার অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাক করব ভাবছি। গতকাল রাতে লাবিব কল করেছিলো। সে সবকিছুর জন্য সরি ফিল করেছে। আবার আমাদের ফিরে পেতে চায়। আমাকে আমার মেয়ের জন্য যেতে হবে। ”আমি দ্বিতীয় বারের মতো বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। শুধু কোনোরকমে হেসে বলি, “শুভকামনা।”
গভীর রাতে আমার খুব জ্বর আসে। সাথে পেটব্যথা। আমি বাবাকে বলি, “আমি ক্লান্ত বাবা। তোমাকে আর মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে।” বাবা আমাকে ডেকে বলে, “তুই শীঘ্রই আমাদের কাছে আসবি বাবু। তোকে আমি কাঁধে নিয়ে ঘুরাবো। “দুদিন পরে আমি পেটের ব্যথার ডাক্তার দেখাই। হাবিজাবি কি সব টেস্ট করে ডাক্তার বলে “খাদ্যনালীতে ক্যান্সার হয়েছে, আপনি মেডিকেলে এডমিট হন।” আমি ধীর পায়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসি। আমার বুকপকেটে সারাজীবনের একমুঠো হাহাকার নিয়ে ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বাবাকে বলি, ” আসি বাবা আমি?”
সমাপ্ত