নিঝুম রাত, চারদিকে পিনপতন নীরবতা। মধ্যরাত্রিতে কোন কাকপক্ষির শব্দ শোনাও ভার। নীরবতার এই বিচিত্র পাহাড় ভেঙ্গে হেঁটে চলেছে সরফরাজ। রাস্তায় শুয়ে থাকা নেড়ি কুকুরের পাশে হেঁটে চলেছে সে। কুকুরগুলো গভীর ঘুমে অচেতন। কুকুরগুলোকে সারাদিন ছুটে বেড়াতে হয়, খাবারের সন্ধানে, আবর্জনার মাঝে। এমন চিন্তা ভাবনা সরফরাজের মাথায় ঘুরছে, তাই বলে কুকুরগুলোর প্রতি তার মনে কোন মায়া-দয়া হচ্ছে না। বরং ধীরে ধীরে এক গভীর ক্ষোভ তার মনে দানা বাঁধছে। কুকুরগুলোর ঘুম তার সহ্যই হচ্ছে না। হঠাৎ করে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা ছোটখাটো একটা ইঁট দূরের সাদা কুকুরটার গায়ে ছুঁড়ে ফেললো সরফরাজ। অব্যর্থ নিশানা!
সাথে সাথেই ঘুম থেকে উঠে গোঙাতে গোঙাতে ছুটে পালালো কুকুরটা। বুঝতেও পারলো না, সরফরাজের সে কি ক্ষতি করেছে, বোঝার কথাও না। সরফরাজের মনের ক্ষোভ বোঝার সামর্থ্য যে তার নেই। কুকুরটার গোঙানি শুনে সরফরাজের একটু খারাপ লাগলো। মনে হলো কুকুরটাকে সে না মারলেও পারতো। এমন ঘটনা সে আগেও করেছে। তখন তো তার এমন খারাপ লাগে নি। বরং মনের ক্ষোভ কিছুটা হলেও কমেছিল। তবে আজ এমন লাগছে কেন?
সরফরাজের মনের এই যে ক্ষোভ, তাও কিন্তু অমূলক নয়। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ভুগলে এমন হতেই পারে। কম তো হলো না। বয়েস পঁয়ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। গত পনের বছর ধরেই তো ভুগছে, হঠাৎ এক রাত থেকে তার এই অনিদ্রা রোগের শুরু, তাও যেন-তেন ভাবে নয়। টানা তিন দিন ঘুমাতে পারে নি সে। এরপর আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু বেশিদিনের জন্যে নয়। কয়দিন বিরতি দিয়েই এই অনিদ্রা রোগ তাকে তাড়া করে ফেরে। এর পিছনে কি কারণ আছে তাও সে আন্দাজ করতে পারে। মাত্র এক সপ্তাহ আগেই সরফাজের আদরের ছোট ভাইটি যে মারা গিয়েছিল। প্রথম দুই দিন সরফরাজ শুধু কেঁদেছিল। এরপর কয়েকদিন তেমন কোন প্রতিক্রিয়াই তার মধ্যে ছিল না। হঠাৎ করেই পঞ্চম দিনের রাতে সরফরাজ তার ভাইকে দেখে, ঘুমের মধ্যে। ভাইটি তার হতবাক চোখে সরফরাজের দিকে তাকিয়ে ছিল। না, সে চোখে কোন ভয় ছিল না, ছিল না কোন আতংক। ছিল শুধু এক হতবাক হওয়া দৃষ্টি, এক অস্ফুট বিস্ময়। “ভাইটি তার কোথায় আছে? কেমন আছে?” – মাঝে মাঝেই প্রশ্ন জাগে সরফরাজের মনে।
“সরফরাজ সাহেব!”- সরফরাজের গভীর ভাবনা ও রাতের নীরবতা উভয়ই যেন ভেঙে খান-খান হয়ে গেল।
“সরফরাজ সাহেব, একটু দাঁড়ান।” – আগন্তুকের কথাটা ছিল অনুরোধ। কিন্তু তা সরফরাজের কাছে আদেশের মতো ঠেকলো। সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে গেল সরফরাজ। তার মন তাকে এগোতে বলছে, কিন্তু তার পা যেন চলছে না। অদ্ভুত এক ভয় ও শান্তি তার মনকে গ্রাস করেছে। ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু পারছে না সে। “সরফরাজ সাহেব, কাজটা আপনি না করলেও পারতেন।”
“কোন কাজ? আপনি কে? আমাকে ডাকলেন কেন হঠাৎ? আপনাকে তো চিনতে পারলাম না ভাই একগাদা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো সরফরাজ। “আমি আপনার অনেক কাছেই থাকি ভাই, প্রতিদিনই দেখি আপনাকে দূর থেকে। কিন্তু, আপনি আমাকে এর আগে কখনো দেখেন নি। আজ এতো বছর পরে আপনার মুখোমুখি হলাম।”
“আপনার নাম জানতে পারি?”-ভদ্রতার সাথে জানতে চাইলো সরফরাজ। “সে আপনি রাত শেষ হবার আগেই জানবেন। চলুন, আমরা চৌরাস্তার দিকে যাই। হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা গল্পও হয়ে যাবে। আগন্তুকের আচরণ কেমন সন্দেহজনক ঠেকছে সরফরাজের কাছে। লোকটার চেহারাও সে দেখতে পাচ্ছে না ঠিকভাবে। ল্যাম্পপোস্টের আলো এতদূরে ঠিকমতো আসছে না। আবছা আলোয় লোকটার চেহারা হালকা পরিচিত ঠেকছে, কোথায় যেন দেখেছে সরফরাজ। কিন্তু, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কে এই আগন্তুক।
“তা কাজটা আপনি কেন করতে গেলেন?”
“আসলে মাথাটা একটু গরম আজকে। আমার সামান্য ঘুমের সমস্যা আছে। তাই কুকুরটাকে ঘুমাতে দেখে সহ্য হলো না।” – সংকোচ নিয়েই বললো সরফরাজ।
“সামান্য?”- শব্দ করে হেসে উঠলেন আগন্তুক। প্রতি রাতেই তো আপনাকে হাঁটতে দেখি। হাসির শব্দ শুনে চমকে গেলো সরফরাজ। ফাঁকা রাস্তায় এই হাসির শব্দটা কেমন এক ভয়ংকর আর্তনাদের মতো লাগলো তার কাছে।
“আপনি কিভাবে জানলেন?”
“বললাম তো, প্রতিদিনই দেখি আপনাকে আমি।”- চটজলদি উত্তর আগন্তকের। কিছুক্ষণ নীরবতা। কি বলবে ভেবে উঠতে পারছে না সরফরাজ। শেষমেষ আগন্তুকই নীরবতা ভাঙলো।
“আজ কতো তারিখ খেয়াল আছে?”
“জ্বী, রাত বারোটা তো পেরিয়েছে অনেক আগেই। জুনের ৭ তারিখ এখন।”
“সালটা কতো?”
আগন্তুকের এই অদ্ভূত প্রশ্নে কিছুটা থমকে গেলো সরফরাজ। মধ্যরাত্রিতে সাল জানতে চাওয়াটা কিছুটা অদ্ভূতই বটে।
“২০২০ সাল। কিন্তু, এই প্রশ্ন কেন হঠাৎ?”
“না মানে, ১৫ বছর আগে আপনার ভাইয়ের মৃত্যুর কথা মনে পড়লো।”
“মানে? ভাইয়ের মৃত্যু দিবস ছিল ৬ই জুন, গতরাতেই। এই নিয়ে শোকের মধ্যেই ছিল সরফরাজ। কিন্তু, হঠাৎ করে অচেনা, অজানা এক লোকের এমন প্রশ্নে ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো সরফরাজের, ক্ষেপে উঠল সে।
“মানে ১৫ বছর আগে একবিংশ শতাব্দির ৬ষ্ঠ বছরের ৬ষ্ঠ মাসের ৬ষ্ঠ তারিখে এক দানবের জন্ম হয়। তারই ১৫ বছর পূর্তি হলো মাত্র। কিন্তু, সেই দানবের পৃথিবীতে টিকে থাকার আর কোন অধিকার নেই।”-আগন্তুকের এই কথায় ভয়ের এক স্রোত বয়ে গেলো সরফরাজের মধ্যে। তার পা দু’টো থমকে দাঁড়াল। হঠাৎ করেই খেয়াল করলো কখন যেন তারা চৌরাস্তায় পৌঁছে গেছে, আর রাস্তার মাঝখানে তারা দু’জন দাঁড়িয়ে আছে। পাগুলো যেন নড়াতে পারছে না সরফরাজ।
“আপনাকে তো নিতান্তই ভদ্রলোক ভেবেছিলাম। কিন্তু, আপনি দেখছি সাক্ষাৎ শয়তান!”- ক্রোধে চেঁচিয়ে উঠলো সরফরাজ। “শয়তান! শয়তান! শয়তান!’- উৎফুল্ল হাসিতে ফেটে পড়লো আগন্তুক। “তা আমি শয়তান বটেই। তা আপনিও কিন্তু কম নন। মনে পড়ে রাত ১১ টার কথা? না, আমি আজ রাত ১১ টার কথাই শুধু বলছি না। আমি গত ১৫ বছরের ৬ই জুনের প্রত্যেকটি রাত ১১ টার কথা বলছি।” প্রচন্ড পরিমাণে একটা শক খেলো সরফরাজ। পা গুলো আরো আড়ষ্ঠ হয়ে গেলো তার।
বলে চললো আগন্তুক, “১৫ বছর আগে, ঠিক রাত ১১ টায় আপনিই অপুকে কুয়ায় ধাক্কা দেন। প্রতি বছর একই দিনে একই সময়ে ১০ বছর বয়সী কোন ছেলের মৃত্যু আপনিই ডেকে আনেন।” ক্রোধে, ক্ষোভে, আতংকে ফেটে পড়ার অবস্থা সরফরাজের। কিন্তু, মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হলো না তার।
“কিন্তু, আপনি বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন যে গতমাসে অপুর বয়েস দশ হলো। ভাইয়ের স্মৃতির কথা ভেবে নিজের ছেলের নামও আপনি অপুই দিয়েছিলেন। কিন্তু, সেই ভাইয়ের স্মৃতিও অপুর মৃত্যু ঠেকাতে পারলো না। তাকেও শেষ পর্যন্ত কুয়ায় পড়তে হলো।” ট্রাকের শব্দ শুনতে পেলো সরফরাজ। কিন্তু, রাস্তার মাঝখান থেকে সে সরতে পারলো না।
“দেখুন, আমাকে যেতে দিন ট্রাক আসছে।”- আর্তনাদ করে উঠলো সরফরাজ। কিন্তু, নড়তে পারলো না।
“আমাকে যেতে দিন ভাই, দোহাই লাগে, মাফ করুন আমাকে। কে আপনি? কি চাই বলুন। যা চাবেন তাই দেবো আপনাকে।”
“বললাম তো, এই দানব আর থাকবে না পৃথিবীতে। আর আমি কে, রাত শেষ হওয়ার আগেই জানতে পারবেন।”-নিষ্ঠুর উত্তর আগন্তুকের। ট্রাক চলে এসেছে খুব কাছে। ইঞ্জিনের গর্জন শুনতে পারছে সরফরাজ। কিন্তু, নড়তে পারছে না। অনেক চেষ্টা করেও পারছে না।
হঠাৎ হেডলাইটের আলো পড়লো আগন্তুকের মুখে। সাথে সাথেই ট্রাকের সামনে থেকে সরার সব ইচ্ছে লোপ পেল সরফরাজের। আগন্তুককে সরফরাজ আসলেই চেনে। অনেক ভালো করেই চেনে। এই আগন্তুক তো সরফরাজ নিজেই!
N B : 666 is the number of devil
Amanat Tasrif
Department Of Civil Engineering, Roll:1701090
Khulna University Of Engineering & Technology, Khulna