ঢাকা ১১:৫৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অকৃত্রিম ভালবাসা

আমার মেয়েযুগল বেশ আনন্দিত ও বিস্মিত। আমার কাজের ব্যাঘাত ঘটানো তাদের অনিবার্যই ছিল। তাদের আনন্দ এবং বিস্ময় এর কারণ দর্শানো জাগতিক সকল কর্মকাণ্ডের ঊর্ধ্বে যে! তাদের মাকেও ছুটে আসতে হল রান্না ঘর থেকে। আমার মোবাইল ফোনটির ৬” পর্দায় ভেসে বেড়াচ্ছে আমাদের পরিবারের এই বছরের বিভিন্ন সময়, স্থান ও অনুষ্ঠানের ছবি। পটভূমিতে আবার জুৎসই বাদ্যযন্ত্রের খেলা। চমৎকার একটি নামও দেওয়া আছে এই ছবি নাটকের: Wonderful Moments of Bipul’s Family.

“বাবা, এই ছবি গুলি কে এত সুন্দর করে সাজালো?” আমার মেয়েযুগলের কন্ঠে বিস্ময় ও আনন্দ দুই-ই। বিস্ময় আমাকেও ছুঁয়ে গেল। তাই তো, কে সাজালো ছবি গুলো? আমি তো সাজাই নি! পরে জানতে পারলাম, এটি আমার মোবাইল ফোন এর কারসাজি। আর এটিকেই বলে “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” বা Artificial Intelligence (AI)|।

“Artificial Intelligence?” আমার মেয়েযুগল এর বিস্ময় দ্বিগুণ হলঃ Artificial Intelligence কি বাবা?” আমি খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিভাবে সহজ ভাষায় বুঝানো যায় ব্যাপারটা? মনে পড়ে গেল রবি ঠাকুরের কবিতাঃ
“সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে,
সহজ কথা যায় কি বলা সহজে?”

সহজে বলার কঠিন কাজটি আমার শুরু হল, “দেখো মায়েরা, Intelligence বা বুদ্ধিমত্তা প্রানিকুলের মাঝেই বিদ্যমান যা আল্লাহ তা’লা’র বিরাট নিয়ামত আর আমরা যে আশরাফুল মাখলুকাত তার কারণ আমাদের এই বুদ্ধিমত্তা বা Intelligence সমগ্র প্রাণিকূলের মধ্যে সেরা। বুদ্ধিমত্তার একটা বড় শক্তি হচ্ছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমরা পেয়েছি আমাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস থেকে, বয়ঃজ্যেষ্ঠদের জীবনযাপন ও কার্যপ্রনালী দেখে এবং নিজের সহজাত প্রবৃত্তি থেকে। যেমন- তোমরা কুকুর’কে ভয় পাও অথচ বিড়াল’কে পাও না। কেন? দু’টি প্রানিরই তো ধারালো নখ আর ধারালো দাঁত আছে? এই পার্থক্যটি তোমরা করতে পারছো বুদ্ধিমত্তার কারণে। হয়তো তোমার মাকে তোমরা দেখেছো বিড়ালকে আদর করতে এবং খেতে দিতে, কিন্তু কুকুরকে দেখেছো বাড়ির উঠোন থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে। এই যে বুদ্ধিমত্তা, এটি প্রকৃতিগতভাবে আমরা পেয়েছি, আলাহ তা’লা আমাদের মাঝে এই জিনিস নিয়ামত স্বরূপ দিয়ে দিয়েছেন।

মানুষ যখন মেশিন তৈরি করল, সেই মেশিন এর কাজ করার ক্ষমতা হল প্রচন্ড। উদাহরন স্বরূপ, ক্যালকুলেটর এর কথা বলা যায়। আমরা দ্রুততার সাথে দুই অথবা তিন অংকের সংখ্যার গুন অথবা ভাগ করতে পারি, এর চেয়ে বেশি অংকের সংখ্যা’র গুণ-ভাগ আমাদের জন্য অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাই না? কিন্তু ক্যালকুলেটর অনেক বড় অংকের সংখ্যার গুণ-ভাগও তুড়ি মেরে করে ফেলতে পারে। ঠিক তেমনি ক্রেইন অনেক ওজনদার জিনিসও অনেক অল্প সময়ে উপরে তুলতে পারে।

মুশকিল হল, মেশিন বলে দেওয়া কাজকে খুব সহজেই নিখুঁত ভাবে করতে পারে, কিন্তু নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু করতে পারে না”।

“ওরেরে! আমার ভাতের সব মাড় পরে গেলরে!” আমার স্ত্রী হুড়মুড় করে রান্নাঘর এর দিকে দৌড়ে গেল। আমরা তিনজনও অপরাধী’র মত রান্নাঘরে গিয়ে হাজির হলাম। “দেখো! তোমাদের ছাতার কথা শুনতে গিয়ে কি সর্বনাশ হয়েছে!” আমার স্ত্রী’র কন্ঠে পরিষ্কার বিরক্তি। “আমরা আবার কি করলাম?” ভীতিকর স্বরে তিনজনই প্রশ্ন করলাম।

“না, তোমরা কিছু করনি, করেছে তোমাদের ওই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” বিরক্তিভরা কন্ঠে আমার স্ত্রীর চুলার আগুন কমিয়ে ভাতের পাতিলের চারপাশ পরিষ্কার করতে লাগল। সুযোগ পেয়ে আমার জ্ঞানের ঝাঁপি আবার খুলে নিলাম, “এই যে একটু অসতর্কতার জন্য তোমার ভাতের মাড় পড়ে গেল, কারণ এই চুলাটি’র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নেই। যখন ভাতের পানিটি মাড়ের ফেনা তুলে উপচে পড়তে নিয়েছিল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থাকলে চুলাটি তখনই নিজে থেকেই তার আগুনের আঁচ কমিয়ে দিত, যা কিনা তুমি এসে করলে।”

“তাই!!” আমার মেয়েদের চোখে-মুখে আনন্দ ও উৎসাহ। “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে আর কি কি করা সম্ভব বাবা?”

উত্তরের প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছি, তখনই কন্যাদের মায়ের মুখ ঝামটা, “তোমাদের বুদ্ধিমত্তা তো দেখি এই চুলার থেকেও কম। বিদেয় হও রান্নাঘর থেকে আর আমাকে শান্তিমত কাজ করতে দাও”।

আমরা তিনজন ত্বরিত সরে পড়লাম রান্নাঘর থেকে আর ফিরে এলাম আমাদের আগের জায়গায়।

“শোন আম্মুরা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যা বলছিলাম। মেশিন খুব ভাল কাজ করলেও নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু করতে পারত না। বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, কিভাবে মেশিনকে বুদ্ধি দেওয়া যায়, যেন সে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণিজগতের বুদ্ধিমত্তা’র উৎস অনুসন্ধানে জানা গেল, এদের বুদ্ধি ধীরে ধীরে বিকাশ পায় আর তা ঘটে শিক্ষার মাধ্যমে। শিশুরা ক্রমাগত শিখতে থাকে বড়দের থেকে আর বড়রা শেখে ইতিহাস থেকে। এই শিক্ষার কারনেই যে কোন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। শিক্ষার বড় একটা মা্যিম হল অভিজ্ঞতা যা ভিন্ন ভিন্ন সময় ও ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে অর্জিত হয়। যার ভান্ডারে যত বেশি অভিজ্ঞতা, শিক্ষার আদান-প্রদান তার জন্য তত সহজ ও কার্যকর। মেশিন শিক্ষার জন্য এই অভিজ্ঞতার নাম হল Data| আর এ জন্যই Artificial Intelligence এর সাথে সাথে Machine Learning শব্দটা উচ্চারিত হয় যা কিনা Data Analysis এর উপর ভর করে চলে”।

“আমাদের AC-টাকে আমি শিক্ষা দিতে চাই, বুদ্ধিমান বানাতে চাই” আমার ছোট মেয়ের চোখে মুখে প্রতিজ্ঞা, “রাতে আমার ঠান্ডা লাগলে ও যেন নিজে নিজে বন্ধ হয়ে যায় আর গরম লাগলে যেন চালু হয়ে যায়। সেটা কি সম্ভব বাবা?”

“অবশ্যই সম্ভব মা”, আমি আবার শুরু করি, “ইদানিং Smart AC বের হয়েছে যা কিনা আমাদের শরীরের তাপমাত্রা ও ঘরের পরিবেশ বিবেচনায় আমাদের জন্য আরামদায়ক ঠান্ডা বাতাস দেয় এবং প্রয়োজনমত চালু ও বন্ধ হয়”।

“রোবট সোফিয়া যে ঢাকায় এসেছিল, ও তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট, তাই না বাবা?” আমার বড় মেয়ে বিজ্ঞের মত প্রশ্ন করে।

“একদম ঠিক বলেছ মা”, মেয়ের বিচক্ষণতায় আমি মুগ্ধ।“রোবট সোফিয়া’র মেমরীতে মানুষের অভিজ্ঞতার সমস্ত data দেওয়া আছে আর তাই তুমি যেকোন প্রশ্ন করলে ও তার সঠিক জবাব দিয়ে দেয়”।

“তাহলে তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মেশিন আমাদের কাজকে অনেক সহজ করে দেবে, তাই না বাবা?” আমার ছোট মেয়ের প্রশ্ন। “ঠিক বলেছ মা”, আমার ছোট্ট জবাব।

“সোফিয়ার মত একটা রোবট থাকলে ও আমাদের স্কুলে নিয়ে যেতে পারত, যমুনা ফিউচার পার্কে নিয়ে যেতে পারত, এমন কি নানু-দাদু বাড়িতেও নিয়ে যেতে পারত”, বড় জনও ছোট জন এর সাথে গলা মেলাল। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। “কিন্তু আমার যদি খুব মন খারাপ করে, যদি কান্না পায়, তাহলে কি রোবট সোফিয়া আমাকে আদর করতে পারবে, আমার মন ভাল করে দিতে পারবে?” ছোট মেয়ের বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁয়েছে।

আমি একটা লম্বা শ্বাস নেই, বুকের ভেতর অক্সিজেন ভর্তি করে ধীরে ধীরে তা আবার ছাড়তে থাকি, “নারে মা! ভালবাসা তো আর কৃত্রিম হয় না। ভালবাসার মত অকৃত্রিম জিনিস শুধু প্রাণিকুলই অর্জন করতে পারে, মেশিন নয়”।

 

ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আনোয়ারুল আলাম আখন্দ

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অকৃত্রিম ভালবাসা

আপডেট সময় ০৬:৩৮:৫৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪

আমার মেয়েযুগল বেশ আনন্দিত ও বিস্মিত। আমার কাজের ব্যাঘাত ঘটানো তাদের অনিবার্যই ছিল। তাদের আনন্দ এবং বিস্ময় এর কারণ দর্শানো জাগতিক সকল কর্মকাণ্ডের ঊর্ধ্বে যে! তাদের মাকেও ছুটে আসতে হল রান্না ঘর থেকে। আমার মোবাইল ফোনটির ৬” পর্দায় ভেসে বেড়াচ্ছে আমাদের পরিবারের এই বছরের বিভিন্ন সময়, স্থান ও অনুষ্ঠানের ছবি। পটভূমিতে আবার জুৎসই বাদ্যযন্ত্রের খেলা। চমৎকার একটি নামও দেওয়া আছে এই ছবি নাটকের: Wonderful Moments of Bipul’s Family.

“বাবা, এই ছবি গুলি কে এত সুন্দর করে সাজালো?” আমার মেয়েযুগলের কন্ঠে বিস্ময় ও আনন্দ দুই-ই। বিস্ময় আমাকেও ছুঁয়ে গেল। তাই তো, কে সাজালো ছবি গুলো? আমি তো সাজাই নি! পরে জানতে পারলাম, এটি আমার মোবাইল ফোন এর কারসাজি। আর এটিকেই বলে “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” বা Artificial Intelligence (AI)|।

“Artificial Intelligence?” আমার মেয়েযুগল এর বিস্ময় দ্বিগুণ হলঃ Artificial Intelligence কি বাবা?” আমি খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিভাবে সহজ ভাষায় বুঝানো যায় ব্যাপারটা? মনে পড়ে গেল রবি ঠাকুরের কবিতাঃ
“সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে,
সহজ কথা যায় কি বলা সহজে?”

সহজে বলার কঠিন কাজটি আমার শুরু হল, “দেখো মায়েরা, Intelligence বা বুদ্ধিমত্তা প্রানিকুলের মাঝেই বিদ্যমান যা আল্লাহ তা’লা’র বিরাট নিয়ামত আর আমরা যে আশরাফুল মাখলুকাত তার কারণ আমাদের এই বুদ্ধিমত্তা বা Intelligence সমগ্র প্রাণিকূলের মধ্যে সেরা। বুদ্ধিমত্তার একটা বড় শক্তি হচ্ছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমরা পেয়েছি আমাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস থেকে, বয়ঃজ্যেষ্ঠদের জীবনযাপন ও কার্যপ্রনালী দেখে এবং নিজের সহজাত প্রবৃত্তি থেকে। যেমন- তোমরা কুকুর’কে ভয় পাও অথচ বিড়াল’কে পাও না। কেন? দু’টি প্রানিরই তো ধারালো নখ আর ধারালো দাঁত আছে? এই পার্থক্যটি তোমরা করতে পারছো বুদ্ধিমত্তার কারণে। হয়তো তোমার মাকে তোমরা দেখেছো বিড়ালকে আদর করতে এবং খেতে দিতে, কিন্তু কুকুরকে দেখেছো বাড়ির উঠোন থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে। এই যে বুদ্ধিমত্তা, এটি প্রকৃতিগতভাবে আমরা পেয়েছি, আলাহ তা’লা আমাদের মাঝে এই জিনিস নিয়ামত স্বরূপ দিয়ে দিয়েছেন।

মানুষ যখন মেশিন তৈরি করল, সেই মেশিন এর কাজ করার ক্ষমতা হল প্রচন্ড। উদাহরন স্বরূপ, ক্যালকুলেটর এর কথা বলা যায়। আমরা দ্রুততার সাথে দুই অথবা তিন অংকের সংখ্যার গুন অথবা ভাগ করতে পারি, এর চেয়ে বেশি অংকের সংখ্যা’র গুণ-ভাগ আমাদের জন্য অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাই না? কিন্তু ক্যালকুলেটর অনেক বড় অংকের সংখ্যার গুণ-ভাগও তুড়ি মেরে করে ফেলতে পারে। ঠিক তেমনি ক্রেইন অনেক ওজনদার জিনিসও অনেক অল্প সময়ে উপরে তুলতে পারে।

মুশকিল হল, মেশিন বলে দেওয়া কাজকে খুব সহজেই নিখুঁত ভাবে করতে পারে, কিন্তু নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু করতে পারে না”।

“ওরেরে! আমার ভাতের সব মাড় পরে গেলরে!” আমার স্ত্রী হুড়মুড় করে রান্নাঘর এর দিকে দৌড়ে গেল। আমরা তিনজনও অপরাধী’র মত রান্নাঘরে গিয়ে হাজির হলাম। “দেখো! তোমাদের ছাতার কথা শুনতে গিয়ে কি সর্বনাশ হয়েছে!” আমার স্ত্রী’র কন্ঠে পরিষ্কার বিরক্তি। “আমরা আবার কি করলাম?” ভীতিকর স্বরে তিনজনই প্রশ্ন করলাম।

“না, তোমরা কিছু করনি, করেছে তোমাদের ওই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” বিরক্তিভরা কন্ঠে আমার স্ত্রীর চুলার আগুন কমিয়ে ভাতের পাতিলের চারপাশ পরিষ্কার করতে লাগল। সুযোগ পেয়ে আমার জ্ঞানের ঝাঁপি আবার খুলে নিলাম, “এই যে একটু অসতর্কতার জন্য তোমার ভাতের মাড় পড়ে গেল, কারণ এই চুলাটি’র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নেই। যখন ভাতের পানিটি মাড়ের ফেনা তুলে উপচে পড়তে নিয়েছিল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থাকলে চুলাটি তখনই নিজে থেকেই তার আগুনের আঁচ কমিয়ে দিত, যা কিনা তুমি এসে করলে।”

“তাই!!” আমার মেয়েদের চোখে-মুখে আনন্দ ও উৎসাহ। “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে আর কি কি করা সম্ভব বাবা?”

উত্তরের প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছি, তখনই কন্যাদের মায়ের মুখ ঝামটা, “তোমাদের বুদ্ধিমত্তা তো দেখি এই চুলার থেকেও কম। বিদেয় হও রান্নাঘর থেকে আর আমাকে শান্তিমত কাজ করতে দাও”।

আমরা তিনজন ত্বরিত সরে পড়লাম রান্নাঘর থেকে আর ফিরে এলাম আমাদের আগের জায়গায়।

“শোন আম্মুরা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যা বলছিলাম। মেশিন খুব ভাল কাজ করলেও নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু করতে পারত না। বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, কিভাবে মেশিনকে বুদ্ধি দেওয়া যায়, যেন সে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণিজগতের বুদ্ধিমত্তা’র উৎস অনুসন্ধানে জানা গেল, এদের বুদ্ধি ধীরে ধীরে বিকাশ পায় আর তা ঘটে শিক্ষার মাধ্যমে। শিশুরা ক্রমাগত শিখতে থাকে বড়দের থেকে আর বড়রা শেখে ইতিহাস থেকে। এই শিক্ষার কারনেই যে কোন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। শিক্ষার বড় একটা মা্যিম হল অভিজ্ঞতা যা ভিন্ন ভিন্ন সময় ও ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে অর্জিত হয়। যার ভান্ডারে যত বেশি অভিজ্ঞতা, শিক্ষার আদান-প্রদান তার জন্য তত সহজ ও কার্যকর। মেশিন শিক্ষার জন্য এই অভিজ্ঞতার নাম হল Data| আর এ জন্যই Artificial Intelligence এর সাথে সাথে Machine Learning শব্দটা উচ্চারিত হয় যা কিনা Data Analysis এর উপর ভর করে চলে”।

“আমাদের AC-টাকে আমি শিক্ষা দিতে চাই, বুদ্ধিমান বানাতে চাই” আমার ছোট মেয়ের চোখে মুখে প্রতিজ্ঞা, “রাতে আমার ঠান্ডা লাগলে ও যেন নিজে নিজে বন্ধ হয়ে যায় আর গরম লাগলে যেন চালু হয়ে যায়। সেটা কি সম্ভব বাবা?”

“অবশ্যই সম্ভব মা”, আমি আবার শুরু করি, “ইদানিং Smart AC বের হয়েছে যা কিনা আমাদের শরীরের তাপমাত্রা ও ঘরের পরিবেশ বিবেচনায় আমাদের জন্য আরামদায়ক ঠান্ডা বাতাস দেয় এবং প্রয়োজনমত চালু ও বন্ধ হয়”।

“রোবট সোফিয়া যে ঢাকায় এসেছিল, ও তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট, তাই না বাবা?” আমার বড় মেয়ে বিজ্ঞের মত প্রশ্ন করে।

“একদম ঠিক বলেছ মা”, মেয়ের বিচক্ষণতায় আমি মুগ্ধ।“রোবট সোফিয়া’র মেমরীতে মানুষের অভিজ্ঞতার সমস্ত data দেওয়া আছে আর তাই তুমি যেকোন প্রশ্ন করলে ও তার সঠিক জবাব দিয়ে দেয়”।

“তাহলে তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মেশিন আমাদের কাজকে অনেক সহজ করে দেবে, তাই না বাবা?” আমার ছোট মেয়ের প্রশ্ন। “ঠিক বলেছ মা”, আমার ছোট্ট জবাব।

“সোফিয়ার মত একটা রোবট থাকলে ও আমাদের স্কুলে নিয়ে যেতে পারত, যমুনা ফিউচার পার্কে নিয়ে যেতে পারত, এমন কি নানু-দাদু বাড়িতেও নিয়ে যেতে পারত”, বড় জনও ছোট জন এর সাথে গলা মেলাল। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। “কিন্তু আমার যদি খুব মন খারাপ করে, যদি কান্না পায়, তাহলে কি রোবট সোফিয়া আমাকে আদর করতে পারবে, আমার মন ভাল করে দিতে পারবে?” ছোট মেয়ের বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁয়েছে।

আমি একটা লম্বা শ্বাস নেই, বুকের ভেতর অক্সিজেন ভর্তি করে ধীরে ধীরে তা আবার ছাড়তে থাকি, “নারে মা! ভালবাসা তো আর কৃত্রিম হয় না। ভালবাসার মত অকৃত্রিম জিনিস শুধু প্রাণিকুলই অর্জন করতে পারে, মেশিন নয়”।

 

ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আনোয়ারুল আলাম আখন্দ