মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সেই ২৫শে মার্চের কালোরাত্রিতে বুয়েটেরই একজন মানুষ নিজের জীবন বাজি রেখে অনেক অনেক ছাত্রের জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন । সেই ঘটনা এবং সেই মানুষটির কথা আমাদের বুয়েটের অনেকেই জানি না । সেই কালোরাতের ঘটনা আর সেই মানুষটিকে নিয়ে আমার এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো বিজয় দিবসে ইউকসু ৯৭ এর প্রকাশনা “মিছিল” এ । বুয়েটের এলামনাইরা অনেকেই হয়তো এই ঘটনা জানেন তারপরেও নতুনদের জন্য সেই লেখাটি কিছুটা কাটছাঁট করে আবার দিলাম –
আজ ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। এদেশের প্রতিটি মানুষের অস্থিত্বের সাথে জড়িত ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ আর সেই বিজয়ের দিন ১৬ই ডিসেম্বর । স্বাধীনতা আর বিজয়ের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে জীবন দিয়েছিলো এদেশের লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ, বীরদর্পে যুদ্ধ করেছিলো এদেশের সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধরা। মহান মুক্তিযুদ্ধে বুয়েট (তৎকালীন ইপুয়েট) এর সচেতন ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী বৃন্দের অনেকেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, জীবন দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য। তাঁদের সবার জন্য সশ্রদ্ধ সালাম ।
আমি আজ বুয়েটের সোহরাওয়ার্দী হলের একজন সিকিউরিটি গার্ড এর কথা লিখতে বসেছি, যিনি এই হলের অগণিত ছাত্রের জীবন বাঁচাতে, নিজের জীবন তুচ্ছ করে অসীম সাহসের সাথে পাক হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিলেন, যিনি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করতে পারেননি, উনি একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক । বুয়েটের আমরা অনেকেই হয়তো চিনিনা সেই সাহসী মানুষটিকে , জানি না তাঁর পরিচয় । সেই মানুষটির নাম মো: সালাউদ্দিন, স্থায়ী ঠিকানা – ৪৫ নং লেন, খাজে দেওয়ান, পো: চকবাজার, লালবাগ, ঢাকা । কয়েক যুগ ধরে সোহরাওয়ার্দী হলের সিকিউরিটি গার্ড হিসাবে চাকুরী করেন, বছর কয়েক আগে অবসরে যান ।
যুগ যুগ ধরে সোহরাওয়ার্দী হলের ছাত্রদের কাছে অতি প্রিয় একজন মানুষ এই সালাউদ্দিন ভাই ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ এর সেই কালোরাত্রির ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে একসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন । উনার মুখেই শোনা সেইদিনের ঘটনা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো –
“১৯৭১ সালে ২৫ শে মার্চ পাকবাহিনী তৎকালীন লিয়াকত হল (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী হল) আক্রমণ করে । সেদিন আমি এবং সোবহান নামে একজন কর্মচারী হলে সিকিউরিটি গার্ডের দায়িত্বে ছিলাম । হঠাৎ করে রাত ১২ টার দিকে পাক বাহিনী গেট ভেঙে তারের বেড়া উপেক্ষা করে গাড়ি নিয়ে হলের ভিতরে প্রবেশ করে । যতদূর মনে পড়ে ৫ ট্রাক ভর্তি পাকিস্তান আর্মির লোক ছিল । কিছু ছাত্র প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পালিয়ে যায় আর কিছু ছাত্র অন্য কোনো উপায় না দেখে হলের ছাদের উপরে পানির ট্যাংকিতে, বাথরুমে এবং অন্যান্য হলে আত্মগোপন করে। ছাত্রদের বাঁচানোর জন্য আমি হলের মেইন সুইচ বন্ধ করে সব বাতি নিভাইয়া দেই। পাকবাহিনী প্রথমে আমাকে ধরে পেটে লাথি মারে, বেয়োনেট দিয়ে খোঁচা মারে, আর সোবহান ভাইকে মারধোর করে গাছের নিচে বসিয়ে রাখে। পাকবাহিনী তখন বলে – “বল শালা ছাত্ররা কোথায় আছে ? না বললে তোকে গুলি করব, জানে মেরে ফেলবো”। আমি নিজে প্রাণ দিতে রাজি তবুও ছাত্রভাইদের মরতে দিব না, মনে মনে আল্লাহকে ডেকে এই সিদ্ধান্ত নিলাম । কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তারা আমাকে ধরে নিয়ে হলের বিভিন্ন স্থানে ঘুরাঘুরি করে। ছাত্রদের সম্পর্কে আবার জানতে চাইলে আমি অস্বীকার করলে আমার উপর তারা নির্মম ভাবে অত্যাচার শুরু করে। অত্যাচারের এক পর্যায়ে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি আর পানি খাইতে চাই। কিন্তু পানি মুখে দেওয়ার আগেই আমাকে লাথি মেরে আবারও ফেলে দেয়। তখন আমার ৮টা দাঁত পড়ে যায় এবং মুখ দিয়ে গল গল করে রক্ত বের হতে থাকে। তারপর টানাহেঁচড়া করে সোবহান ভাই আর আমাকে দাঁড় করালো এবং মৃত্যুর জন্য তৈরী হতে বললো। আমরা চুপ করে বোবার মত দাঁড়িয়ে থাকলাম। পাক বাহিনীর এক অফিসার তখন সামনের দিকে
দৌড়ানোর জন্য নির্দেশ দিল। চারিদিকে পাকিস্তান আর্মির সৈন্যরা দাঁড়িয়ে, কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। এমন সময় সোবহান ভাই দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করলে তারা মেশিনগান দিয়ে গুলি করে।
প্রথমে আমার তলপেটে গুলি লাগলে আমি মাটিতে পড়ে যাই। আর সোবহান ভাইয়ের বুক ভেদ করে গুলি পিছন দিক দিয়ে বের হয়ে যায়, যার ফলে সোবহান ভাই সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। আমি যন্ত্রণায় ছটফট করছি দেখে আবার গুলি করলে একটা আমার বাম হাঁটুতে আরেকটা বাম উরুতে লাগে। কিছুক্ষণ পরে আমি মরি নাই দেখে আবারও গুলি করলে আমার বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে এবং কনুই এর উপর গুলি লাগে, আমার শরীরে মোট ৫টা গুলি লাগে।
সারা রাত পাকবাহিনী হলের মধ্যেই অবস্থান করে, সকাল প্রায় ৭টার দিকে চলে যাওয়ার সময় আমাকে মাটিতে যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখে আবারও লাথি মারে আর বেয়োনেট এর খোঁচা দিয়ে চলে যায়। অনেকক্ষণ পরে পলাশী থেকে বাহিরের লোকজন দেয়াল টপকে হলের ভিতরে আসলে আমি ইশারায় তাদের কাছে ডাকি । তারা আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। আমি একসময় পানি খাইতে চাইলে মারা যাব এই ভেবে পানি খাইতে দিল না। ডাক্তাররা আমার হাতের একটা টিপসই নিলেন, ইনজেকশন দিলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই, তারপর আর কিছুই আমার মনে পড়ে না। প্রায় মাসখানেক পরে আমি কোনমতে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আবারও হলে আসি, কিন্তু কাউকে না পেয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাই। সেখানে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করি। কিন্তু আমার শারীরিক অসুস্থাতার জন্য আমাকে তারা মুক্তিযুদ্ধে নিল না। সেই দুঃখ আমি আজও ভুলতে পারি না। তবুও পরম করুণাময়ের কাছে হাজার শুকরিয়া আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। যার জন্য জীবন দিয়েছেন সোবহান ভাইয়ের মত লাখ লাখ নিরীহ মানুষ। আর নিজের জীবন বাজি রেখে হলেও এই হলের ছাত্র ভাইদের জীবন রক্ষা করতে পারছি, এইটাই বড় পাওয়া।”
সালাউদ্দিন ভাই কয়েক যুগ ধরে নিষ্ঠার সাথে সোহরাওয়ার্দী হলের গার্ডের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বছর কয়েক আগে অবসরে গিয়েছেন। সোহরাওয়ার্দী হলের আবাসিক ছাত্রদের কাছে অতি পরিচিত একজন প্রিয় ব্যক্তিত্ব এই সালাউদ্দিন ভাই। তিনি এখনো পুরোপুরি সুস্থ না, সারাদিনে মাত্র এক বেলা খেয়ে বেঁচে আছেন, কারণ কিছু খেলেই মাঝে মাঝেই উনার পেট ফুলে ওঠে। বছর কয়েক আগে উনার একবার অপারেশন করে যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন বয়ে বেড়ানো একটা গুলি অপসারণ করা হয়েছিল। তৎকালীন ভিসি স্যার, হলের প্রভোস্ট এবং আবাসিক ছাত্রদের আর্থিক সহায়তায় উনার অপারেশন হয়েছিল। তারপরেও বর্তমানে শারীরিক অসুস্থতা এবং আর্থিক অসচ্ছলতার মাঝেই দিন যাপন করছেন। এত কিছুর পরেও উনাকে কোনদিন দায়িত্বে কোনরকম অবহেলা করতে দেখি নাই । অথচ নির্মম হলেও সত্য এই সাহসী মানুষটি দীর্ঘ দিন ধরে বুয়েট কর্তৃপক্ষের কাছে ইনক্রিমেন্ট এর জন্য আবেদন করলেও বুয়েট কর্তৃপক্ষ তা মঞ্জুর করেনি। আমি পাশ করার আগে একবার হলের প্রভোস্ট স্যারের সাথে এই ব্যাপারে আমারও কথা হয়েছিল কিন্তু সফল হতে পারি নাই, জানি না শেষ পর্যন্ত হয়েছিল কি না ।
সারা বাংলাদেশে এমন আরো কত সালাউদ্দিন ভাই আছেন যারা ১৯৭১ এর সেই রক্তঝরা দিন গুলিতে দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই আহত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে অনেকেই অনেক ব্যবসা করলেও এই সকল আহত মানুষরা স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো সরকারের কাছ থেকেই তেমন কোনোপ্রকার সহায়তা কিংবা স্বীকৃতি পায় নাই। আমরা বুয়েটের ছাত্র ছাত্রীরাও অনেকেই চিনি না এই সালাউদ্দিন ভাইকে, জানি না তার পরিচয়, যিনি সোহরাওয়ার্দী হল (তৎকালীন লিয়াকত হল) এর ছাত্রদের জীবন বাঁচানোর জন্য নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করেছিলেন। আমি পাশ করার পরেও যতবারই হলে যেতাম সালাউদ্দিন ভাইয়ের খোঁজ খবর নেয়ার চেষ্টা করতাম। বছর কয়েক আগে খবর পাই, উনি অবসরে গেছেন। এই মুহুর্তে কোথায় আছেন কেমন আছেন, সেই খবর আমার জানা নাই। উনি যেখানেই থাকুক সুস্থ থাকুক ভালো থাকুক, এই কামনাই করি।
প্রকৌশলী মোঃ আবুল কালাম আজাদ কল্লোল
তড়িৎ কৌশল, ব্যাচ ৯১, বুয়েট
সাবেক যুগ্ম সম্পাদক, ইউকসু