সারা পৃথিবীতে জ্বালানী একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানী ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে, তাই প্রয়োজন নতুন কোন প্রযুক্তি, নতুন জ্বালানী। নবায়নযোগ্য ও পরিবেশ বান্ধব জ্বালানী এই সময়ের খুব গুরত্বপূর্ণ গবেষণার ক্ষেত্র। সারা পৃথিবীর কথা ছেড়ে দিলেও এই বাংলাদেশে এখনও অগনিত বৃক্ষ নিধন করা হয় শুধু মাত্র জ্বালানী কাঠের জন্য। এটা মর্মান্তিক ও নিষ্ঠুর। গাছ কাটতে হয়, অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনেই, প্রাকৃতিক দুর্যোগেও অনেক গাছ নষ্ট হয়। কিন্তু গাছ যখন কাটতেই হয় প্রয়োজনে, তখন যেন তার প্রতিটা বিন্দুই কাজে লাগে, একটুও যেন ফেলনা না যায়।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় উচ্চতর গবেষণা খুব একটা হচ্ছে বলে মনে হয়না। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, প্রকৌশল ও কারিগরি জ্ঞান এবং সেই সাথে উচ্চতর গবেষণা একটা জাতির মেরুদন্ডে ইস্পাতসম দৃঢ়তা দান করে এটা আর কথার কথা নয়, প্রমাণিত সত্য।
অনেক দিন থেকে মনে হচ্ছে, আমরা কতো কিছুইনা ফেলে দিই, কিন্তু এ গুলো থেকে যদি জ্বালানী তৈরি করা যায় বিষয়টা মন্দ হয়না। চেষ্টা ছিল এমনি কিছু একটা করার, অনেকটুকু সময় গেছে গবেষণাতেই কিন্তু তাতে কি ? শেষ পর্যন্ত সাফল্য পাওয়া গেল। আমার মত দরিদ্র প্রকৌশলীর জন্য গবেষণা অতি অবশ্যই ঘোড়ারোগ। কিন্তু রক্তের ভেতর এই গবেষক হবার বীজ সম্ভবত প্রকৌশলী হবার আগে থেকেই ছিল। তাই আর্থিক সাফল্য এই জীবনে না পেলেও অনেক গুলো উদ্ভাবন আমার হাতেই ঘটেছে, কিন্তু সে গুলো পাদপ্রদীপের আলোতে আসেনি, আসবেইবা কেন, আমরা প্রকৌশীরা বাণিজ্য করতে ব্যাস্ত, উদ্ভাবন নয়। এই দেশে উদ্ভাবন ও উদ্ভাবকের লালনের সংস্কৃতিই নেই।
নবায়নযোগ্য ও পরিবেশ বান্ধব এই দুইয়ের সমন্বয় করে, বলতে গেলে ফেলনা কাঠের গুঁড়ো (স-মিলে কাঠ চেরাই করার পর যে গুঁড়ো পাওয়া যায়) সেটা দিয়েই প্রথম চেষ্টা, এই কাঠের গুঁড়ো থেকে তৈরি হল বাংলাদেশের প্রথম কঠিন (Solid Fuel) জ্বালানী। বিষয়টা অনেকের কাছেই নিশ্চয় খুব মামুলী মনে হচ্ছে, তা হোক এটা আমার কপিরাইট প্রোডাক্ট। এই জ্বালানীর উপাদান, প্রস্তুত প্রক্রিয়া ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সবই আমার কপিরাইট এর আওতায়। আর এটি তৈরির সকল যন্ত্রপাতির নক্সা থেকে সংযোজন সবই করেছি আমি এই বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসে। তাহলে বোধ হয় ভাল কিছু করতে চাইলে ইচ্ছা আর ত্যাগটাই বড় বিষয়, বাকি গুলো খুবই গৌণ। প্রথমত গবেষণাটি ফেলনা কাঠের গুঁড়ো থেকে হলেও আমার উদ্ভাবিত প্রক্রিয়া ও যন্ত্র এখন এতটাই সক্ষম যে এটি এখন নষ্ট হয়ে যাওয়া কাঠ, বাঁশ, ঘাস, গাছের পাতা, তরিতরকারির উচ্ছিষ্ট, খড়, ক্ষেতের আগাছা সবকিছুকেই জ্বালানীতে রূপান্তর করতে সক্ষম। যা সব ফেলনা তাই সব জ্বালানীতে পরিণত হচ্ছে। বিষয়টি বেশ মজার তাইনা? হুম আমিও তাকিয়ে তাকিয়ে থাকি বিস্ময়ে “তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী আমি অবাক হয়ে শুনি”…………।
এই দেশে কাঠের গুঁড়োর তেমন একটা বাণিজ্যিক ব্যবহার নেই বললেই চলে। মশা মারার কয়েল তৈরি ছাড়া ব্যাপক ভাবে আর বিশেষ কোন ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার হয় না। প্রশ্ন হতে পারে কোথাও কোথাও এটি রান্নার কাজেও ব্যবহৃত হয়, আমি বলব এটি অপচয়। সেটি এক লম্বা একাডেমিক পর্যালোচনার বিষয়। আচ্ছা তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়, কোথায় এবং কতটুকু? রান্নাই কি একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে জ্বালানী ব্যবহৃত হয়? অপব্যয় এই জন্যই বলা হচ্ছে এই কাঁচামাল ব্যবহার করে যে জ্বালানী তৈরি হতে পারে তার ব্যবহারের ব্যাপকতা রয়েছে। রান্না ঘর থেকে শুরু করে বৃহৎ শিল্পেও এই জ্বালানী ব্যবহৃত হতে পারে। অধুনা শিল্পে যে গ্যাসের সঙ্কট পোহাতে হয় তার অনেকটুকুই কেটে যেতে পারে এই জ্বালানী ব্যবহারে।
মনে রাখা প্রয়োজন এটি একটি Bio-Mass Fuel. কেননা সকল উদ্ভিজ্জ উচ্ছিষ্টই এই জ্বালানীর কাঁচামাল। যেহেতু এটি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কাঁচামাল বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয় তাই এই জ্বালানী দহনে তেমন একটা ধোঁয়া তৈরি হয়না। এই জ্বালানী দহনে অতি নগন্য কার্বন এবং নামমাত্র সালফার নিঃসরণ ঘটে, এই জ্বালানী দহনে কোন দুর্গন্ধ তৈরি হয়না। আর কি চাই একটি আদর্শ জ্বালানীর জন্য? ও হ্যা তাপ উৎপাদন ক্ষমতা! এই ক্ষেত্রেও হতাশ হবার কোন কারণ নেই, কাঠের গুঁড়ো ব্যবহার করে যে জ্বালানী তৈরি হয় সেটির তাপ উৎপাদন ক্ষমতা ৫২০০-৫৫০০ কিলো-ক্যালরি/কেজি। আর দামের কথা বললে বলতে হয় এই মূল্যে কোন জ্বালানী কাঠও বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না।
যেহেতু এটি একটি কপিরাইট প্রোডাক্ট তাই এই জ্বালানী তৈরির প্রক্রিয়া না হয় ̄স্ব-বিস্তারে নাই বললাম। তবে উৎপাদন প্রক্রিয়ার কিছু ছবি দেখা যেতেই পারে।
কাঠের গুঁড়োর কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়া পুরাতন কাঠ ও কাঠের গুঁড়ো Fermented করে, বিশেষ ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয় কাঁচামাল এর পর এই কাঁচামাল কে বিশেষভাবে উচ্চ তাপ ও চাপ যন্ত্রে প্রবেশ করিয়ে তৈরি করা হয় “কাঠের গুঁড়ো থেকে কঠিন জ্বালানী” এই জ্বালানীর গুরত্বপূণ দিক হল, এটি পরিবেশ বান্ধব, বলতে গেলে প্রায় ধোঁয়া বিহীন। উচ্চ তাপ উৎপাদনে সক্ষম, কিন্তু মূল্য বেশ কম। গৃহস্থালি থেকে শিল্প পর্যন্ত যেখানেই তাপ প্রয়োজন, সেখানেই এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
এটি এক দিকে যেমনি ফেলে দেওয়া জিনিষ ব্যবহার করে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে, অন্যদিকে ধোঁয়াবিহীন স্বল্পমূল্যের জ্বালানী। এই জ্বালানী তৈরির প্রক্রিয়া ও যন্ত্রপাতি সবই স্খানীয় ভাবে তৈরি যা দীর্ঘ দুই বছরের গবেষণার ফসল। বলাই বাহুল্য এই কপিরাইটটি ২০১৯ সনে জাতীয় মেধাসম্পদ সংরক্ষণ সম্মাননা লাভ করে।
গাছে গাছে সবুজ পত্র পল্লবে সুসজ্জিত হোক আমাদের এই দেশ। দেশ বাঁচাই, পরিবেশ বাঁচাই; শিল্প গড়ি ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্টের জ্বালানী দিয়ে। সমৃদ্ধ হোক আমাদের শিল্প, সমৃদ্ধ হোক আমাদের প্রযুক্তি। নতুন প্রজন্ম নব নব উদ্ভাবনে সমৃদ্ধ করুক এই বাংলাদেশকে।
প্রকৌশলী আনোয়ারুল আজিম খান অঞ্জন
ম্যানেজিং পার্টনারঃ ওয়ার্কম্যান ইঞ্জিনিয়ারিং