ঢাকা ১১:১৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সভ্যতার প্লট কার্ভ ও করোনাযুগ

  • শামিম রাব্বি
  • আপডেট সময় ০৭:২৮:৩৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪
  • ৪৩ বার পড়া হয়েছে

সময়, মহাবিশ্বে একমাত্র স্বাধীন চলক – ”the only independent variable”। সময়ের সাথে বিশ্বে-মহাবিশ্বে প্রতিটি ঘটনাই একেকটি নাটকের প্লটের মতো ঘটে চলেছে। নাটকের প্লট মূলতঃ একটি কার্ভ (curve) বা বক্ররেখা মেনে চলে। এই কার্ভের মূল পাঁচটি অংশ থাকে। ১. কাহিনীমুখ বা প্রকাশ (exposition), ২. কাহিনীর ক্রমব্যাপ্তি (rising action), ৩. চূড়াস্পর্শী নাট্যদ্বন্দ্ব বা শীর্ষবিন্দু (climax), ৪. গ্রন্থিমোচন (falling action), এবং ৫. যবনিকাপাত (conclusion)।

এক
একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, বিশ্বে-মহাবিশ্বের প্রতিটি ঘটনাই নাটকের প্লটের পাঁচটি অংশের মতো এই একই কার্ভে আবর্তিত হয়। যেমন- সূর্যোদয় হলো exposition; সকাল থেকে দুপুরের সূর্য মধ্যগগনে আসার আগ পর্যন্ত rising action; মধ্যগগনের সূর্য হলো climax; দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত falling action আর সূর্যাস্ত হলো conclusion বা যবনিকাপাত। সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে একটি দিনের যবনিকাপাত হলেও সূর্যাস্ত মানেই সবকিছুর শেষ নয় ! পরদিন আবারও নতুন সূর্য ওঠে, নতুন আশা নিয়ে। শুরু হয় আরও একটি নতুন নাটকের প্লট। প্রতিটি দিনই চলে এই একই চক্রে। প্রতিটি নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, গ্যালাক্সী নিজ নিজ কক্ষপথে একই চক্র মেনে চলে প্রতিনিয়ত।

দুই
আবার মানুষের জীবনও কিন্তু নাটকের প্লটের মতোই। মাতৃগর্ভ হলো প্রকাশ বা, exposition। শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকে তরুন বয়স পর্যন্ত সময়টা হলো rising action। যৌবন কাল, মানুষের জীবনের গোন্ডেন পিরিয়ডকে climax বা মানুষের জীবনের শীর্ষবিন্দু বলাই যায়। যৌবন শেষে একদিকে মানুষ তার জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে জীবন রহস্যের গ্রন্থি উন্মোচন করতে থাকে আর অন্য দিকে প্রাকৃতিক নিয়মে শরীরের দীপ্তি প্রতিনিয়ত কমতে থাকে। যৌবন শেষ হবার পর থেকে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত সময়টা মানুষের জীবনের falling action। এবং মৃত্যু হলো জীবনের conclusion বা যবনিকাপাত। কিন্তু, মৃত্যু মানেই কি মানুষের জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া ? নাকি আরও একটি নতুন জীবনের শুরু ?

তিন-১
এবার দৃষ্টিপাত করা যাক মানব সভ্যতার দিকে। মানব সভ্যতার exposition বা, প্রকাশ সহজ ছিল না মোটেই ! আদিম মানুষের ‘বর্বরতা’ (savagery) থেকে ‘বন্যতা’ (barbarism) এবং ‘বন্যতা’ থেকে ‘সভ্যতা’ (civilization)-এর উন্মেষ ঘটাতে হাজার হাজার বছর লেগেছিল। এই ‘বর্বরতা’- ‘বন্যতা’- ‘সভ্যতা’ উত্তরণের সময়টাকেই মানব সভ্যতার কাহিনীমুখ বা, exposition বলা যায়। প্রস্তরযুগ; ধাতবযুগ; মেসোপটেমিয় সভ্যতা; অ্যাসিরীয় সভ্যতা; ক্যালদীয় বা, নব্য ব্যাবিলনীয় সভ্যতা; মিশরীয় সভ্যতা; হিব্রু, হিটাইট ও ফিনিশীয় সভ্যতা; প্রাচীন পারস্য সভ্যতা; প্রাচীন ভারতীয় (সিন্ধু) সভ্যতা ও আর্য সভ্যতা; এজিয়ান সভ্যতা, গ্রিক সভ্যতা; রোমীয় সভ্যতা; প্রাচীন চীনা সভ্যতা সব মিলিয়ে খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৩০/৪০ হাজার বছর থেকে শুরু করে ৪০০ খ্রিষ্টাব্দে মধ্যযুগ শুরুর আগ পর্যন্ত এই ৩০৪০০ বা, ৪০৪০০ বছরের অতি দীর্ঘ সময়টাই হলো মানব সভ্যতার কাহিনীমুখ বা, exposition বা প্রকাশ।

তিন-২
৪০০ খ্রিষ্টাব্দে মধ্যযুগের সূচনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মানব সভ্যতার ক্রমব্যাপ্তি বা rising action। খ্রিষ্টধর্মের আবির্ভাব, পোপতন্ত্র, ইংল্যান্ডের স্যাকসন রাজত্ব, সামন্ততন্ত্র, বায়জানটাইন সাম্রাজ্য, স্যারাসেনিক (আরব) সভ্যতা, ইসলামের আবির্ভাব, ইসলামী খেলাফত (৬২২-১২৫৮ খ্রি.), জাতীয় রাজতন্ত্র, পোপ সাম্রাজ্যের উত্থান (৮৫৮-১২১৮ খ্রি.), ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ (১০৯৫-১২৯১ খ্রি.), রেনেসাঁ (১৩০০-১৬৫০ খ্রি.) এবং পাশাপাশি নব ইসলামী খেলাফত উসমানীয় বা অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান ও সম্প্রসার (১২৯৯-১৮৭৬ খ্রি.) – মানব সভ্যতার ক্রমব্যাপ্তিরই (rising action) উল্লেখযোগ্য অধ্যায় মাত্র। প্রাচীনযুগ থেকে মধ্যযুগ হয়ে আধুনিক সভ্যতার শুরু পর্যন্ত ইউক্লিড, অ্যারিস্টটল, আল খোয়ারিজমি, ইবনে সিনা, আল বিরুনী, ওমর খৈয়াম, গ্যালিলিও, রবার্ট হুক, স্যার আইজাক নিউটন, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, জেমস ওয়াটসহ অসংখ্য বিজ্ঞানী ও দার্শনিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক আবিষ্কার করেন। কিন্তু, ১৮০০ সালের পূর্বে মানুষের ব্যবহারিক জীবনে এইসব মৌলিক আবিষ্কারের প্রয়োগ তেমন ছিল না বললেই চলে। ১৮০০ সালের পর থেকে টমাস আলভা এডিসন, আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল, লুই পাস্তুর, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, মেরি কুরি, চার্লস ডারউইন, আলবার্ট আইনস্টাইন, অটো হান ও নিকোলা তেসলার মতো আধুনিক বিজ্ঞানীদের পরিশ্রমলব্ধ ব্যবহরিক গবেষণার ফলেই মূলতঃ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের ব্যবহার ও প্রয়োগ শুরু হয়। কিন্তু, স্টীম ইঞ্জিন থেকে ইনটার্নাল কমবাসশন ইঞ্জিন, টু স্ট্রোক থেকে ফোর স্ট্রোক ইঞ্জিন হয়ে রকেটের জেট প্রপালশন ইঞ্জিন, ডিসি মোটর থেকে এসি মোটর, সিঙ্গেল ফেজ থেকে থ্রি ফেজ মোটর – মানুষের লাইফ স্টাইলে আমূল পরিবর্তন আনা এইসব মূল প্রযুক্তির সফল বিবর্তন ঘটে ১৮০০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত। তাই মোটমুটি ৪০০ খ্রি. থেকে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই ১৫০০ বছর সময় জুড়েই ছিল মানব সভ্যতার ক্রমব্যাপ্তি বা rising action।

তিন-৩
১৯০৩ সালে রাইট ব্রাদার্সের বিমান আবিষ্কার, বিংশ শতাব্দীতে জল, স্থল, আকাশ পথ ও মহাশূন্যে মানুষের তৈরী যন্ত্রের ব্যাপক আধিপত্য এবং ইলেক্ট্রনিক্সযুগের গগনচুম্বী বিপ্লব একসাথে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা, জীবনের মান, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে পৌঁছে দেয় সভ্যতার চরম শিখরে। একদিকে মানুষের জীবন ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় যন্ত্রের ব্যবহার ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হতে থাকে, ফলে অন্য দিকে পরিবেশ দূষণও ধীরে ধীরে ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতর হতে থাকে। তাই ১৯০০ সালের পর এসে সভ্যতা-‘খলনায়ক’ আর প্রকৃতি-‘নায়ক’-এর ভূমিকায় অবতীর্ন হয়। বিংশ শতাব্দীতে সভ্যতা ও প্রকৃতি পরস্পরকে মোকাবিলা করার জন্য সম্পূর্ণ বিপরীত দিক থেকে একে অন্যের মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে। আর মানব সভ্যতা পৌঁছে যায় চূড়াস্পর্শী নাট্যদ্বন্দ্ব বা climax-এ। মানুষের জীবনের মান উন্নয়নের উপকরণের পাশাপাশি আধুনিক মরণাস্ত্রও সভ্যতার ক্লাইমেক্সে যোগ করে নতুন মাত্রা ! মানুষের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ প্রযুক্তি নির্ভর। ১৯০০ সালের পর ঘটে – দুইটি বিশ্বযুদ্ধ, যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতি, পারমাণবিক শক্তির সক্ষমতা, ইলেক্ট্রনিক্স যুগের ব্যাপক উত্থান, কম্পিউটার থেকে সুপার কম্পিউটার, চাঁদ থেকে মঙ্গল হয়ে প্লুটো অভিযান, এপোলো থেকে ভয়েজার হয়ে নিউ হরাইজোন, বেতার থেকে স্যাটেলাইট! পাশাপাশি বিপরীতে ও সমান্তরালে ঘটে যায়- পরিবেশ দূষণ, গ্রীনহাউস ইফেক্ট, বৈশ্বিক উষ্ণতা, জলবায়ু পরিবর্তন, ওজনস্তর ক্ষয়, এইডস এর প্রাদুর্ভাব, ঘরে ঘরে ক্যান্সার এবং সর্বশেষ বর্তমানে ইতিহাসের ভয়াবহতম কোভিড-১৯ বৈশ্বিক অতিমারী। শুরু হয়েছে করোনা-যুগ ! করোনাযুগ বলার কারণ, গত প্রায় এক বছর যাবৎ একসাথে স্থবির হয়ে পড়েছে সমস্ত পৃথিবী, সমস্ত সভ্যতা ! পৃথিবীর সকল বৃহৎ শক্তি সবকিছু বাদ দিয়ে ছুটছে একটিমাত্র সফল ভ্যাক্সিনের গবেষণায় ! বিশেষজ্ঞদের মতে, ভ্যাক্সিন আসলেও মানুষ হয়তো অদূর ভবিষ্যতে করোনা অতিমারীর আগের পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে না সহজে। মানুষ হয়তোবা সহজে আর মাস্ক, সেনিটাইজার, সামাজিক দূরত্বকে অতিক্রম করে আগের মতো সহজ, সাবলীল জীবন যাপনে ফিরে যেতে পারবে না। প্রতি নিয়ত করোনার নতুন নতুন স্ট্রেইন সমস্ত সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করে বিভ্রান্ত করে চলেছে একসাথে সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে। তাই পৃথিবীতে শুরু হয়েছে নতুন যুগ -‘করোনাযুগ’। আর এই ফাঁকে প্রকৃতি, মানব সভ্যতার গ্রন্থিমোচন করে ধীরে ধীরে পুষিয়ে নিচ্ছে তার বিগত শতাব্দীর ক্ষতি। সভ্যতার যাঁতাকলে দূষিত প্রকৃতি চেষ্টা করছে দূষণমুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে স্বরূপে ফিরে যেতে। তাই বহুযুগ পর আবারও কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে খেলা করছে ডলফিন, বহুযুগ পর উত্তরবঙ্গ থেকে আবারও দৃশ্যমান হচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা।

তিন-৪
১৯০০ সাল থেকে ২০১৯ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ১১৯ বছরই কি তবে মানব সভ্যতার climax ? ২০২০-এ করোনা-যুগের সাথে সাথে কি সভ্যতার গ্রন্থিমোচন বা falling action শুরু হয়ে গেছে ? সভ্যতার এই গ্রন্থিমোচন বা falling action কত বছর বা কত শত বছর চলবে ? falling action এর পরেই কি আসবে মানব সভ্যতার যবনিকাপাত বা, conclusion ? যবনিকাপাতেই কি মানব সভ্যতা সম্পূর্ণশেষ হয়ে যাবে ? নাকি শুরু হবে আরেক নতুন সভ্যতা ? অথবা, শুরু হবে বাইবেল, আল-কুরআনসহ অনেক ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত সেই চিরস্থায়ী অনন্ত জীবন ? সব কিছুরই জবাব দেবে সময় – ”the only independent variable in the universe” !

শামিম রাব্বি

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

সভ্যতার প্লট কার্ভ ও করোনাযুগ

আপডেট সময় ০৭:২৮:৩৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

সময়, মহাবিশ্বে একমাত্র স্বাধীন চলক – ”the only independent variable”। সময়ের সাথে বিশ্বে-মহাবিশ্বে প্রতিটি ঘটনাই একেকটি নাটকের প্লটের মতো ঘটে চলেছে। নাটকের প্লট মূলতঃ একটি কার্ভ (curve) বা বক্ররেখা মেনে চলে। এই কার্ভের মূল পাঁচটি অংশ থাকে। ১. কাহিনীমুখ বা প্রকাশ (exposition), ২. কাহিনীর ক্রমব্যাপ্তি (rising action), ৩. চূড়াস্পর্শী নাট্যদ্বন্দ্ব বা শীর্ষবিন্দু (climax), ৪. গ্রন্থিমোচন (falling action), এবং ৫. যবনিকাপাত (conclusion)।

এক
একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, বিশ্বে-মহাবিশ্বের প্রতিটি ঘটনাই নাটকের প্লটের পাঁচটি অংশের মতো এই একই কার্ভে আবর্তিত হয়। যেমন- সূর্যোদয় হলো exposition; সকাল থেকে দুপুরের সূর্য মধ্যগগনে আসার আগ পর্যন্ত rising action; মধ্যগগনের সূর্য হলো climax; দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত falling action আর সূর্যাস্ত হলো conclusion বা যবনিকাপাত। সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে একটি দিনের যবনিকাপাত হলেও সূর্যাস্ত মানেই সবকিছুর শেষ নয় ! পরদিন আবারও নতুন সূর্য ওঠে, নতুন আশা নিয়ে। শুরু হয় আরও একটি নতুন নাটকের প্লট। প্রতিটি দিনই চলে এই একই চক্রে। প্রতিটি নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, গ্যালাক্সী নিজ নিজ কক্ষপথে একই চক্র মেনে চলে প্রতিনিয়ত।

দুই
আবার মানুষের জীবনও কিন্তু নাটকের প্লটের মতোই। মাতৃগর্ভ হলো প্রকাশ বা, exposition। শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকে তরুন বয়স পর্যন্ত সময়টা হলো rising action। যৌবন কাল, মানুষের জীবনের গোন্ডেন পিরিয়ডকে climax বা মানুষের জীবনের শীর্ষবিন্দু বলাই যায়। যৌবন শেষে একদিকে মানুষ তার জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে জীবন রহস্যের গ্রন্থি উন্মোচন করতে থাকে আর অন্য দিকে প্রাকৃতিক নিয়মে শরীরের দীপ্তি প্রতিনিয়ত কমতে থাকে। যৌবন শেষ হবার পর থেকে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত সময়টা মানুষের জীবনের falling action। এবং মৃত্যু হলো জীবনের conclusion বা যবনিকাপাত। কিন্তু, মৃত্যু মানেই কি মানুষের জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া ? নাকি আরও একটি নতুন জীবনের শুরু ?

তিন-১
এবার দৃষ্টিপাত করা যাক মানব সভ্যতার দিকে। মানব সভ্যতার exposition বা, প্রকাশ সহজ ছিল না মোটেই ! আদিম মানুষের ‘বর্বরতা’ (savagery) থেকে ‘বন্যতা’ (barbarism) এবং ‘বন্যতা’ থেকে ‘সভ্যতা’ (civilization)-এর উন্মেষ ঘটাতে হাজার হাজার বছর লেগেছিল। এই ‘বর্বরতা’- ‘বন্যতা’- ‘সভ্যতা’ উত্তরণের সময়টাকেই মানব সভ্যতার কাহিনীমুখ বা, exposition বলা যায়। প্রস্তরযুগ; ধাতবযুগ; মেসোপটেমিয় সভ্যতা; অ্যাসিরীয় সভ্যতা; ক্যালদীয় বা, নব্য ব্যাবিলনীয় সভ্যতা; মিশরীয় সভ্যতা; হিব্রু, হিটাইট ও ফিনিশীয় সভ্যতা; প্রাচীন পারস্য সভ্যতা; প্রাচীন ভারতীয় (সিন্ধু) সভ্যতা ও আর্য সভ্যতা; এজিয়ান সভ্যতা, গ্রিক সভ্যতা; রোমীয় সভ্যতা; প্রাচীন চীনা সভ্যতা সব মিলিয়ে খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৩০/৪০ হাজার বছর থেকে শুরু করে ৪০০ খ্রিষ্টাব্দে মধ্যযুগ শুরুর আগ পর্যন্ত এই ৩০৪০০ বা, ৪০৪০০ বছরের অতি দীর্ঘ সময়টাই হলো মানব সভ্যতার কাহিনীমুখ বা, exposition বা প্রকাশ।

তিন-২
৪০০ খ্রিষ্টাব্দে মধ্যযুগের সূচনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মানব সভ্যতার ক্রমব্যাপ্তি বা rising action। খ্রিষ্টধর্মের আবির্ভাব, পোপতন্ত্র, ইংল্যান্ডের স্যাকসন রাজত্ব, সামন্ততন্ত্র, বায়জানটাইন সাম্রাজ্য, স্যারাসেনিক (আরব) সভ্যতা, ইসলামের আবির্ভাব, ইসলামী খেলাফত (৬২২-১২৫৮ খ্রি.), জাতীয় রাজতন্ত্র, পোপ সাম্রাজ্যের উত্থান (৮৫৮-১২১৮ খ্রি.), ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ (১০৯৫-১২৯১ খ্রি.), রেনেসাঁ (১৩০০-১৬৫০ খ্রি.) এবং পাশাপাশি নব ইসলামী খেলাফত উসমানীয় বা অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান ও সম্প্রসার (১২৯৯-১৮৭৬ খ্রি.) – মানব সভ্যতার ক্রমব্যাপ্তিরই (rising action) উল্লেখযোগ্য অধ্যায় মাত্র। প্রাচীনযুগ থেকে মধ্যযুগ হয়ে আধুনিক সভ্যতার শুরু পর্যন্ত ইউক্লিড, অ্যারিস্টটল, আল খোয়ারিজমি, ইবনে সিনা, আল বিরুনী, ওমর খৈয়াম, গ্যালিলিও, রবার্ট হুক, স্যার আইজাক নিউটন, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, জেমস ওয়াটসহ অসংখ্য বিজ্ঞানী ও দার্শনিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক আবিষ্কার করেন। কিন্তু, ১৮০০ সালের পূর্বে মানুষের ব্যবহারিক জীবনে এইসব মৌলিক আবিষ্কারের প্রয়োগ তেমন ছিল না বললেই চলে। ১৮০০ সালের পর থেকে টমাস আলভা এডিসন, আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল, লুই পাস্তুর, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, মেরি কুরি, চার্লস ডারউইন, আলবার্ট আইনস্টাইন, অটো হান ও নিকোলা তেসলার মতো আধুনিক বিজ্ঞানীদের পরিশ্রমলব্ধ ব্যবহরিক গবেষণার ফলেই মূলতঃ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের ব্যবহার ও প্রয়োগ শুরু হয়। কিন্তু, স্টীম ইঞ্জিন থেকে ইনটার্নাল কমবাসশন ইঞ্জিন, টু স্ট্রোক থেকে ফোর স্ট্রোক ইঞ্জিন হয়ে রকেটের জেট প্রপালশন ইঞ্জিন, ডিসি মোটর থেকে এসি মোটর, সিঙ্গেল ফেজ থেকে থ্রি ফেজ মোটর – মানুষের লাইফ স্টাইলে আমূল পরিবর্তন আনা এইসব মূল প্রযুক্তির সফল বিবর্তন ঘটে ১৮০০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত। তাই মোটমুটি ৪০০ খ্রি. থেকে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই ১৫০০ বছর সময় জুড়েই ছিল মানব সভ্যতার ক্রমব্যাপ্তি বা rising action।

তিন-৩
১৯০৩ সালে রাইট ব্রাদার্সের বিমান আবিষ্কার, বিংশ শতাব্দীতে জল, স্থল, আকাশ পথ ও মহাশূন্যে মানুষের তৈরী যন্ত্রের ব্যাপক আধিপত্য এবং ইলেক্ট্রনিক্সযুগের গগনচুম্বী বিপ্লব একসাথে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা, জীবনের মান, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে পৌঁছে দেয় সভ্যতার চরম শিখরে। একদিকে মানুষের জীবন ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় যন্ত্রের ব্যবহার ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হতে থাকে, ফলে অন্য দিকে পরিবেশ দূষণও ধীরে ধীরে ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতর হতে থাকে। তাই ১৯০০ সালের পর এসে সভ্যতা-‘খলনায়ক’ আর প্রকৃতি-‘নায়ক’-এর ভূমিকায় অবতীর্ন হয়। বিংশ শতাব্দীতে সভ্যতা ও প্রকৃতি পরস্পরকে মোকাবিলা করার জন্য সম্পূর্ণ বিপরীত দিক থেকে একে অন্যের মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে। আর মানব সভ্যতা পৌঁছে যায় চূড়াস্পর্শী নাট্যদ্বন্দ্ব বা climax-এ। মানুষের জীবনের মান উন্নয়নের উপকরণের পাশাপাশি আধুনিক মরণাস্ত্রও সভ্যতার ক্লাইমেক্সে যোগ করে নতুন মাত্রা ! মানুষের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ প্রযুক্তি নির্ভর। ১৯০০ সালের পর ঘটে – দুইটি বিশ্বযুদ্ধ, যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতি, পারমাণবিক শক্তির সক্ষমতা, ইলেক্ট্রনিক্স যুগের ব্যাপক উত্থান, কম্পিউটার থেকে সুপার কম্পিউটার, চাঁদ থেকে মঙ্গল হয়ে প্লুটো অভিযান, এপোলো থেকে ভয়েজার হয়ে নিউ হরাইজোন, বেতার থেকে স্যাটেলাইট! পাশাপাশি বিপরীতে ও সমান্তরালে ঘটে যায়- পরিবেশ দূষণ, গ্রীনহাউস ইফেক্ট, বৈশ্বিক উষ্ণতা, জলবায়ু পরিবর্তন, ওজনস্তর ক্ষয়, এইডস এর প্রাদুর্ভাব, ঘরে ঘরে ক্যান্সার এবং সর্বশেষ বর্তমানে ইতিহাসের ভয়াবহতম কোভিড-১৯ বৈশ্বিক অতিমারী। শুরু হয়েছে করোনা-যুগ ! করোনাযুগ বলার কারণ, গত প্রায় এক বছর যাবৎ একসাথে স্থবির হয়ে পড়েছে সমস্ত পৃথিবী, সমস্ত সভ্যতা ! পৃথিবীর সকল বৃহৎ শক্তি সবকিছু বাদ দিয়ে ছুটছে একটিমাত্র সফল ভ্যাক্সিনের গবেষণায় ! বিশেষজ্ঞদের মতে, ভ্যাক্সিন আসলেও মানুষ হয়তো অদূর ভবিষ্যতে করোনা অতিমারীর আগের পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে না সহজে। মানুষ হয়তোবা সহজে আর মাস্ক, সেনিটাইজার, সামাজিক দূরত্বকে অতিক্রম করে আগের মতো সহজ, সাবলীল জীবন যাপনে ফিরে যেতে পারবে না। প্রতি নিয়ত করোনার নতুন নতুন স্ট্রেইন সমস্ত সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করে বিভ্রান্ত করে চলেছে একসাথে সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে। তাই পৃথিবীতে শুরু হয়েছে নতুন যুগ -‘করোনাযুগ’। আর এই ফাঁকে প্রকৃতি, মানব সভ্যতার গ্রন্থিমোচন করে ধীরে ধীরে পুষিয়ে নিচ্ছে তার বিগত শতাব্দীর ক্ষতি। সভ্যতার যাঁতাকলে দূষিত প্রকৃতি চেষ্টা করছে দূষণমুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে স্বরূপে ফিরে যেতে। তাই বহুযুগ পর আবারও কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে খেলা করছে ডলফিন, বহুযুগ পর উত্তরবঙ্গ থেকে আবারও দৃশ্যমান হচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা।

তিন-৪
১৯০০ সাল থেকে ২০১৯ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ১১৯ বছরই কি তবে মানব সভ্যতার climax ? ২০২০-এ করোনা-যুগের সাথে সাথে কি সভ্যতার গ্রন্থিমোচন বা falling action শুরু হয়ে গেছে ? সভ্যতার এই গ্রন্থিমোচন বা falling action কত বছর বা কত শত বছর চলবে ? falling action এর পরেই কি আসবে মানব সভ্যতার যবনিকাপাত বা, conclusion ? যবনিকাপাতেই কি মানব সভ্যতা সম্পূর্ণশেষ হয়ে যাবে ? নাকি শুরু হবে আরেক নতুন সভ্যতা ? অথবা, শুরু হবে বাইবেল, আল-কুরআনসহ অনেক ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত সেই চিরস্থায়ী অনন্ত জীবন ? সব কিছুরই জবাব দেবে সময় – ”the only independent variable in the universe” !

শামিম রাব্বি