১. পর্বতমালা হতে বরফগলিত জলের স্রোত অথবা ঝরনাধারার মিষ্টি জল অভিকর্ষের টানে মাটির বুক চিড়ে ঢালের দিকে নিরন্তর ছুটে চলে সাগরের নোনা জলে গিয়ে মিলিত হয় – এরই নাম নদী। সমতল পলিসমৃদ্ধ মাটির বুক চিড়ে সোহাগে বয়ে যাওয়া মায়াবী নদীর দেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। অসংখ্য ছোট-বড় নদী জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে তৈরী করেছে নদীমাতৃক বাংলাদেশ। ভারত ও মিয়ানমারের পর্বতমালা হতে উৎপন্ন হয়ে ৫৭টি দুঃসাহসী নদী সীমানা পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে। এই আন্তর্জাতিক নদীসমূহ শাখা-প্রশাখা মেলে দেশের ভিতর সৃষ্টি করেছে শত শত ছোট বড় নদী। একসময় সাত শতাধিক নদীর অস্তিত্ব থাকলেও কালের নির্মম পরিহাসে তার অনেকগুলোরই জীবনাবসান হয়েছে – বর্তমানে টিকে আছে প্রায় দুইশ এর কিছু বেশি নদী। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ভারত মহাসাগরের বে অব বেঙ্গল বা বঙ্গোপসাগরের সাথে য্ক্তু। নদীর উৎপত্তি যেখানেই হোক না কেন দেশের সকল নদীই গিয়ে শেষ আশ্রয় খুঁজেছে বঙ্গোপসাগরের নোনা জলে। নদীর মিষ্টি জল আর সাগরের নোনা জলের প্রধান পার্থক্য হলো পানিতে লবণের (সোডিয়াম ক্লোরাইড) পরিমান। মিষ্টি ও নোনা জলে লবণের পরিমান যথাক্রমে ০.০৫ শতাংশ ও ৩%-৫% শতাংশ।
২. আন্তর্জাতিক নদীসমূহের আরেকটি নাম আন্তঃসীমান্ত নদী – যে সকল নদী একাধিক দেশের সীমানা পেরিয়ে প্রবাহিত হয়। দেশের পশ্চিমে ভারত হতে সাতক্ষীরা সীমান্ত পেরিয়ে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত রায়মঙ্গল নদী আর পূর্বে মায়ানমার হতে কক্সবাজার সীমান্ত পেরিয়ে নাফ নদী ছাড়াও অন্যতম আন্তঃসীমান্ত নদীসমূহের মধ্যে রয়েছে- গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, ফেনী, সুরমা, কুশিয়ারা, গোমতী, মাতামুহুরী, মনু, খোয়াই, মহানন্দা ইত্যাদি। দেশের নদীসমূহের রয়েছে বৈচিত্র্যময় নাম। সুন্দরতম নামের অনেক নদী থাকলেও ভয়ঙ্কর নামের নদীর সংখ্যাও কম নয়। আরো আছে ধর্মীয় নাম। অন্যতম সুন্দর নামের নদীসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চিত্রা, রূপসা, সুরমা, যমুনা, মধুমতি, ধানসিঁড়ি, নীলকমল, নরসুন্দর, মালঞ্চ, সুগন্ধা, পায়রা, ডাহুক, কোকিল, সোনাই, আন্ধারমানিক, ইছামতী, কীর্তনখোলা প্রভৃতি। অপরদিকে, খোলপেটুয়া, বিষখালী, ডাকাতিয়া, গলাচিপা, মাথাভাঙ্গা, ঘোড়ামারা, আগুনজ্বালা, পাগলা, কাঁচিকাটা, ভুতের গাঙ্গ ইত্যাদি ভয়ঙ্কর নামের নদীর সংখ্যাও কম নয়। নদীর নামকরণে ধর্মের প্রভাবও কম নয়। যেমন- গঙ্গা, নবগঙ্গা, বুড়িগঙ্গা, তুলশীগঙ্গা, কালিগঙ্গা, হরি, ধলেশ্বরী, যমুনেশ্বরী, গর্ভেশ্বরী, ভুবনেশ্বরী, সোমেশ্বরী, রামপাল, দুর্গাদহ, বুড়িশ্বর, বলেশ্বর, কাঠেশ্বর, শ্মশানঘাট ইত্যাদি।
৩. সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা এই বাংলাদেশের প্রকৃতি ও অর্থনীতিতে নদীর অন্যতম প্রভাব উল্লেখযোগ্য। এদেশের নদীসমূহ বাংলাদেশের প্রকৃতির অবারিত অপরূপ এক সৌন্দর্য। ছয়টি ভিন্ন ঋতুতে এই নদীসমূহ নিজেকে মেলে ধরে নানারূপে। দেশের কৃষিসম্পদ এবং মৎস্য সম্পদ সমৃদ্ধ করার পেছনে রয়েছে নদীগুলোর অন্যতম সহায়ক ভূমিকা। মাছে ভাতে বাঙ্গালীর নানান প্রজাতির মিঠা পানির মাছসমূহের অভয়ারণ্য হচ্ছে দেশের নদীসমূহ। শুকনো মৌসুমে নদীর পানি ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন করার লক্ষ্যে লালমনিরহাট জেলায় তিস্তা নদীর উপর তিস্তা ব্যারাজ এবং মৌলভীবাজার জেলায় মনু নদীর উপর মনু ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়েছে। ব্যারাজ দেখতে ব্রিজের মতো হলেও ব্যারাজের খুঁটিসমূহের মাঝে অনেকগুলো গেট থাকে যেগুলো খুলে বা বন্ধ করে ব্যারাজের উজানে নদীর পানির উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এভাবে শুকনো মৌসুমে নদীর পানির উচ্চতা বাড়িয়ে নদী সংলগ্ন খাল দিয়ে প্রবাহিত করে তা জমিতে সরবরাহ করে কৃষি উৎপাদন করা হয়।
কুষ্টিয়া জেলায় ভেড়ামারায় নির্মিত পাম্প স্টেশনের মাধ্যমে গঙ্গা নদীর পানি পাম্প করে সেচখালে ফেলে তা দিয়ে কৃষি উৎপাদন করা হয় কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও চুয়াডাঙ্গা জেলার বিস্তীর্ণ কৃষিজমিতে – যা জিকে প্রজেক্ট নামে পরিচিত। ষাটের দশকে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে নির্মাণ করা হয় কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্প। উজান থেকে আসা জল ১৫০ ফুট উঁচু কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে আটকিয়ে সৃষ্টি হয়েছে কাপ্তাই লেক। গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে পানির চাপ বৃদ্ধির কৌশলকে কাজে লাগিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে তৈরী করা হয় বিদ্যুৎ। এ কারণেই এই বিদ্যুতের নাম জলবিদ্যুৎ। ২৩০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্পে রয়েছে ৫টি টারবাইন। কৃষি উৎপাদন, বিদ্যুৎ তৈরী ইত্যাদি ছাড়াও নদীর অন্যতম ব্যবহার হচ্ছে নৌপথে পরিবহন ব্যবস্থায়। এ কারণেই নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান প্রধান শহরসমূহ, যেমন – বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা, কর্ণফুলির তীরে চট্টগ্রাম, সুরমার তীরে সিলেট, রূপসার তীরে খুলনা, শীতলক্ষ্যার তীরে নারায়ণগঞ্জ, পুরানো ব্রহ্মপুত্রের তীরে ময়মনসিংহ ইত্যাদি। দেশের রাজধানী ঢাকা শহরকে ঘিরে রেখেছে পাঁচটি নদী – তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী।
৪. নদীর সাথে বাঙ্গালীর জীবন ও সংস্কৃতির সম্পর্ক গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। নদীকে নিয়েই রচিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের অসংখ্য গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গান ও চলচ্চিত্র। ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’, ‘পদ্মার ঢেউরে মোর শুন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যারে’, সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা, তোমার বেলায় নেব সখী তোমার কানের সোনা’, ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে শুধাই, বল আমারে তোর কি রে আর কূল কিনারা নাই’, ‘নদীর একূল ভাঙ্গে ওকূল গড়ে এইতো নদীর খেলা, সকালবেলা আমীররে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা’ – নদীকে নিয়ে ইত্যাদি কালজয়ী গান সমৃদ্ধ করেছে বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে। বিশিষ্ট গীতিকার ও সুরকার খান আতাউর রহমান রচিত ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবে না’ – এই বিখ্যাত গানটিতে মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের ত্যাগ ও বীরত্বের কথা অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে নদী-জীবন কেন্দ্রিক যেসব উপন্যাস প্রাধান্য পেয়েছে তার মধ্যে অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’ অন্যতম। নদী তার বিচিত্র বিকাশ আর বৈশিষ্ট্যের পরস্পর অবস্থানকে প্রবল দাপটে বাংলা কবিতার শিকড়মূলে গেঁথে নিয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’, জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে ধাঁনসিড়িটির তীরে, এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়, হয়তো বা শংখচিল শালিকের বেশে’, যশোর-সাতক্ষীরা জেলা দিয়ে প্রবাহিত কপোতাক্ষ নদকে নিয়ে মাইকেল মধুসূদনের ‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে’, পল্লী কবি জসীম উদ্দীন এর বিখ্যাত নিমন্ত্রণ কবিতায় পল্লীর অপরিসীম সৌন্দর্য বর্ণনায় ‘ছোট গাঁওখানি – ছোট নদী চলে তারি একপাশ দিয়া, কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া’ ইত্যাদি কালজয়ী কবিতায় নদীমাতৃক বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যের চিত্র ফুটে উঠেছে। একাত্তরের মাঝামাঝিতে যখন কলকাতায় গুজব রটলো যে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করবে, তখন পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কবি অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর বীরত্ব ও নেতৃত্বকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কবিতা লিখলেন ‘যতদিন রবে পদ্মা, যমুনা, গৌরি মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান। দিকে দিকে রক্ত গঙ্গা অশ্রু গঙ্গা বহমান, তবু নাহি ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান’। বাংলা চলচ্চিত্রে নদীর রয়েছে অনন্য অবদান ও স্থান। আলমগীর কবির পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ধীরে বহে মেঘনা’, তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ‘নদীর নাম মধুমতি’, সাদেক খান পরিচালিত ‘নদী ও নারী’, গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সারেং বউ’, ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত ‘চিত্রা নদীর পারে’, সাম্প্রতিককালে গিয়াসউদ্দিন সেলিম পরিচালিত ‘মনপুরা’ ইত্যাদি বিখ্যাত চলচ্চিত্র সমূহে বাংলার নদীকেন্দ্রিক জীবন ও সংস্কৃতির চিত্র ফুটে উঠেছে।
৫. নদীমাতৃক বাংলাদেশের উন্নয়ন, জীবন ও সংস্কৃতিতে নদীর ভূমিকা অপরিসীম হলেও দেশে নারী নির্যাতনের মত নদী নির্যাতনও সমানতালে চলছে। বিপদাপন্ন, মহাবিপদাপন্ন বা বিলুপ্তির পথে অনেক নদী। উজানের দেশ ভারতে আন্তঃসীমান্ত নদীসমূহের উপর অনেক বাঁধ নির্মাণ করে নদীর পানি আটকিয়ে রেখে বা প্রত্যাহার করার ফলে শুকনো মৌসুমে ভাটির বাংলাদেশে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় হয়ে চলেছে। দেশের ভিতরে নদী দখলের প্রতিযোগিতা, প্রবাহ বাধাগ্রস্থ, শিল্প বর্জ্য দূষণ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ইত্যাদি নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের নদীসমূহ। দক্ষিণের চিত্রা, কীর্তনখোলা বা কপোতাক্ষ, উত্তরের করতোয়া, দক্ষিণ-পশ্চিমের রূপসা-ভৈরব বিপন্নপ্রায় নদী। পাবনার ইছামতি, কিশেরাগঞ্জের নরসুন্দর, নাটোরের নারোদ নদ, গাইবান্ধার ঘাঘট, নেত্রকোনার সোমেশ্বরী, কুমিল্লার গোমতী বিলুপ্তির পথে কতিপয় নদ-নদী। উজানের প্রবাহের পলিপতন আর সাগর থেকে উঠে আসা লবণাক্ততা -এই দুই প্রাকৃতিক আগ্রাসনকে উস্কে দিচ্ছে জনপদ-জনগনের শিল্পবর্জ্য দূষণ, দখলদার-ভূমিদস্যুদের অবৈধ নদী দখল ও ভরাট ইত্যাদি নানাবিধ দানবীয় ও মানবীয় অত্যাচার। নদী আমাদের অস্তিত্বের অংশ, নদী আমাদের নান্দনিকতার উৎস। নদীর বন্যা রোধ করে, নদীর পলি অপসারন করে, নদীর ভাঙ্গন ঠেকিয়ে নদীকে তার আপন গতিতে চলতে দিতে হবে। দূষণ-দখলের হাত থেকে নদীকে বাঁচাতে প্রয়োজন পরিবেশ আইন ও পানি আইনের যথাযথ প্রয়োগ। আসুন আমরা সকলে নদীকে ভালবাসি, নদীর কাছে ফিরে যাই, নদী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। নদী বাঁচাই, দেশ বাঁচাই, বাঁচাই আমাদের জীবন, সভ্যতা ও সংস্কৃতি।
ডঃ মোঃ আতাউর রহমান
অধ্যাপক, পানিসম্পদ কৌশল বিভাগ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
ই-মেইলঃ ataur91@gmail.com