ঢাকা ১১:৩১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করোনা যুগের প্রবর্তন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হয়তো এই প্রথম করোনা অতিমারী প্রথম একটা বৈশ্বিক ঘটনা যা সমগ্র পৃথিবীর সবগুলো দেশের জীবনযাত্রা একসাথে থমকে দিয়েছে। খোলা মাঠের ঘাসে গড়াগড়ি দিয়ে বেড়ে উঠা প্রজন্মের উত্তরসুরিরা এখন খুব সম্ভবত বেড়ে উঠবে মাস্ক অথবা ঘরের খাঁচায়। অথচ এই করোনা ভাইরাস কিন্তু নতুন কিছু নয়, আমরা অনেক আগে থেকেই জেনে-না জেনে এই ভাইরাসটির সাথে বসবাস করছি। হালকা সর্দি কাশি আমাদের সবার-ই কমবেশি হয়, এই হালকা ঠান্ডা লাগাতেও করোনা হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ নয়। গড়ে ১৫% হালকা সর্দি কাশির কারণ করোনা প্রজাতির ভাইরাস। তাহলে কিভাবে এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠল এই চেনা ভাইরাস ? আমরা কি আসলেই পারব একে ঠেকাতে ? নাকি নিজেদের অভিযোজিত করতে হবে করোনার সাথে?

১৯৬৫ সাল। ভাইরোলজির স্বর্ণযুগ। গবেষকরা মাত্র গবেষণাগারে ভাইরাস কালচার করা আরম্ভ করেছেন। বিভিন্ন ভাইরাস কিভাবে বৃদ্ধি পায়, কোন ঔষধ কোন ভাইরাসের উপরে কাজ করে তা পরীক্ষা করে দেখছেন। টাইরেল আর বাইনো নামের দুইজন গবেষক এই সময়ে আবিষ্কার করলেন বি ৮১৪ ভাইরাস। এই ভাইরাস এতটাই নিরীহ ছিল যে, তারা এই ভাইরাসটি মানুষের নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে দেখলেন যে তা সামান্য সর্দি কাশি ছাড়া আর কিছুর উদ্রেগ করে না। এই সময়ে খুব বেশী কিছু জানা যায়নি এই ভাইরাসগুলো নিয়ে। ১৯৬৮ সালে টাইরেল এবং আমেডিয়া প্রথম ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে ভাইরাসগুলো দেখেন এবং জানান যে এগুলো দেখতে রশ্মি বিকীর্ণ সূর্যের মত, যা দেখতে মুকুট সদৃশ। ‘করোনা’ একটি ল্যাটিন শব্দ, যার অর্থ ‘মুকুট’। তাই, এই মুকুটের মত দেখতে ভাইরাসের অবয়ব থেকেই এই ভাইরাসগুলোর নামকরণ করা হয় করোনা ভাইরাস। অসুখের তীব্রতা কম হওয়ায় এরা তখনও আলোচনায় আসেনি।

গবেষকরা যখন মানবদেহের করোনা ভাইরাস মোকাবিলা নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন, করোনা ভাইরাস তখন অবাধে নিজেকে
অভিযোজিত করে নিচ্ছিলো পশুপাখির মাধ্যমে। ইঁদুর, মুরগী, কুকুর, বিড়াল, বাদুর, খরগোস ইত্যাদি প্রানীদের মাঝে পাওয়া যাচ্ছিল করোনার নতুন নতুন স্ট্রেইন।

পশুপাখি থেকে মানুষে ভাইরাসের সংক্রমণ তখনও চিন্তার কারণ হয়নি। এই সুযোগে দু-দিনে সেরে যাওয়া অসুখের তালিকার এই করোনা হঠাৎ করেই শিরোনামে চলে আসে ২০০৩ সালে। ‘সিভিয়ার অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিন্ড্রোম’ বা ‘সার্স’-এর মাধ্যমে। দক্ষিন চায়নায় এটি প্রথম খুঁজে পাওয়া যায়। তবে পশুপাখি থেকেই সার্স-এর উৎপত্তি কিনা তা জানতে বন্য পশু ব্যবসায়ীদের পরীক্ষা করে দেখা যায় তাদের ৪০% সার্স পজিটিভ। উপসর্গ ছাড়াই যে এই করোনা ভাইরাস পশুপাখী থেকে মানব দেহে এসে ওত পেতে বসে থাকে, তা এই সময়ে পরিষ্কার হয়ে উঠে। জিনোম গবেষণা ও সংক্রমণের কঠোর প্রতিরোধে, ২৯ দেশে ছড়িয়ে পড়া এই সার্স ৭৭৪ জন মানুষের প্রাণ নিয়ে বিদায় নেয় ২০০৪ সালে আর আমাদের জন্য রেখে যায় হুঁশিয়ারবানী। এরপরে ২০১২ সাল পর্যন্ত দুইটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে করোনা ভাইরাসের নতুন সংক্রমণ পাওয়া যায়নি। ২০১২ সালে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে করোনা ভাইরাস। এবার, মধ্যপ্রাচ্যে, এম ই আর এস – সি ও ভি নামে। সার্সের চাইতেও ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পরে এই ভাইরাস সৌদি আরবে, নিয়ে যায় ৪৯৫ জন মানুষের প্রাণ।

খটমটে বিজ্ঞানের ভাষায় চিন্তা না করে ঘটনাগুলো দেখে কিন্তু এমনটাই মনে হয় যে এই করোনা অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছে মানবজাতিকে ভয়াবহ ভাবে আক্রমন করতে। নিরীহ ভাবে জন্ম নিলেও, সে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিল পারিপার্শ্বিকতার সাথে। সাবধান হওয়ার সুযোগ না দিয়ে, মানব দেহে সামান্য ঠান্ডার বেশে ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছিল পশুপাখির দেহে। শুধুমাত্র বাদুরের দেহেই তাই এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে অন্তত ৫০ ধরনের করোনা ভাইরাস। একটা ভাইরাস যখন মানব দেহে জন্ম নেয় তখন সে তার নিজের স্বার্থেই মানিয়ে নেয় মানুষের সাথে। এই ধরনের ভাইরাসের মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত সক্ষমতা কিছুটা হলেও আমাদের আছে। কিন্তু যখন অন্য প্রাণীর দেহে জন্ম নেওয়া ভাইরাস মানবদেহে ঝাঁপিয়ে পরে, তখন দেখা যায় বিপত্তি। আর এই করোনা ভাইরাস ছিল ঠিক তাই। ধারনা করা হয় এই বাদুর-ই এই ভাইরাসের প্রধান আশ্রয়স্থল। আর এই বাদুর থেকেই আরেকবারের মত মাথাচাড়া দিয়ে উঠে করোনা ভাইরাস ২০১৯ এর ডিসেম্বরে, চায়নার উহানে।

চায়নার উহান শহর বিখ্যাত তার কাঁচা মাংসের বাজারের জন্য। বাংলাদেশের প্রচলিত পশুপাখি ছাড়াও আরো নানা রকমের পশুপাখির হাটবাজার বসে উহানে। যদিও বাদুরের মাংস সে সময় নিষিদ্ধ ছিল উহানে। খুব সম্ভবত চায়নার বিভিন্ন দুর্গম গুহার কোন এক বাদুরের দেহে বেড়ে উঠা এক করোনা ভাইরাসের স্ট্রেইন ছড়িয়ে পরে কোন এক পশুর মাঝে। আর সেই পশুর মাংস থেকে তা চলে আসে মানবদেহে। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে তা আলোকগতিতে ছড়িয়ে পরে হাজার হাজার মানুষে। চায়না সরকারের টনক নড়ার আগেই তা মহামারীতে পরিণত হয়। নিজেদের দোষ ঢাকতে ব্যস্ত চায়না সরকারের গড়িমসিতে তা ছড়িয়ে পরে পৃথিবীর প্রায় সব-কটা দেশে। এই ভাইরাসের নামকরণ করা হয় সার্স-কোভ-২, আর এই ভাইরাসের সংক্রমণে সৃষ্ট অসুখের নাম দেওয়া হয় কোভিড-১৯। এর পরের বাকিটা সবাই আমরা কম বেশি জানি। তবে এখানে প্রশ্ন হল, ১৯৬৫ সালে আবিষ্কৃত এই ভাইরাস, যা কিনা গত ১৬ বছরে দুইবার হানা দিল, তার প্রতিরোধে এত সময় কেন লাগছে?

সার্স-কোভ-২ একধরনের আর এন এ ভাইরাস। এই ভাইরাসগুলো আসলে সহজ ভাষায় তেল জাতীয় লিপিডের আবরণে প্রোটিনের একটি সুতো। এই ভাইরাসের দেহ থেকে মুকুটের মতন স্পাইক ছড়িয়ে থাকে। এই স্পাইকগুলো মানবদেহের এসিই-২ এনজাইমের সাথে আটকে যায়। সার্স-কোভ-২ আরো ভয়ংকর কারণ সে নিজেকে বিবর্তিত করে নিয়েছে তার স্পাইক প্রোটিনকে পরিবর্তিত করে। সব করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন কিন্তু মানবদেহে আটকে যেতে পারেনা, কোভ-২ তার স্পাইক প্রোটিন-কে পরিবর্তিত করেছে মানবদেহে অতি-সহজে প্রবেশ করতে। শরীরে প্রবেশ করেই এই ভাইরাসের কাজ হল নিজের এই এন প্রোটিন সুতোটা বা আরএনএ কে মানব দেহের কোষের উপাদান ব্যবহার করে কপি করা ও তাকে লিপিডে আবৃত করে নিজের মতন অসংখ্য ভাইরাস তৈরি করা। এভাবেই দেহে ছড়িয়ে পরে সার্স-কোভ-২। তবে এই ধরনের ভাইরাসের আরএনএ অনুকরনের প্রক্রিয়াটি একেবারে নিখুঁত নয়। এই অনুকরনে প্রায়শঃ ভুল করে বসে তারা। আর এর জন্যই এক দেহ থেকে আরেক দেহে সংক্রমণের মাঝেই পাল্টে যেতে পারে ভাইরাস। এই পালটে যাওয়াটাকে বলে মিউটেশন। এই মিউটেশন সবসময় যে খারাপ তা নয়, অনেক সময় মিউটেশনের মাধ্যমে ভাইরাস তার প্রকোপ হারিয়ে বসে। তবে সমস্যা হল এই মিউটেশন খুব বেশী হলে এক মিউটেশনের ভ্যাক্সিন বদলে যাওয়া ভাইরাসকে রুখতে পারবেনা।

এই ভ্যাক্সিন তৈরির প্রক্রিয়াটি কিন্তু মজার। ভাইরাসের থাকে অ্যান্টিজেন, সেই অ্যান্টিজেনকে চিনতে পারে নির্দিষ্ট কিছু অ্যান্টিবডি। কোন একটা ভাইরাস যদি আমাদের দেহের আগে থেকে চেনা থাকে, তাহলে সেই ভাইরাসকে চিনতে পারা অ্যান্টিবডি আমাদের দেহে প্রস্তুত থাকে। আর তাই সেই চেনা ভাইরাস দেহে প্রবেশ করা মাত্র অ্যান্টিবডি ঝাঁপিয়ে পরে ভাইরাসগুলোকে মেরে ফেলে। কিন্তু অচেনা কোন ভাইরাস আমাদের দেহে প্রবেশ করলে আমাদের দেহ তখন বেকায়দায় পরে যায়, কারণ উপযুক্ত অ্যান্টিবডি তৈরি থাকেনা। এই সুযোগে ভাইরাস ছড়িয়ে পরে সারা দেহে।

ভ্যাক্সিন আসলে এই ভাইরাসের নিরাপদ সংস্করন অথবা ভাইরাসের একটি অংশ যাতে অ্যান্টিজেন থাকে কিন্তু রোগ সৃষ্টিকারী অংশটুকু থাকেনা। এই নিরাপদ অ্যান্টিজেন দেহে নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রবেশ করলে আমাদের শরীরে তখন উপযুক্ত অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, ফলে পরবর্তীতে আসল ভাইরাসের জন্য তৈরি থাকে আমাদের দেহ। কিন্তু শরীরের এই অ্যান্টিবডি তৈরি বা ইমিউন রেস্পন্সের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে।

ধরুন একটা রোগ যাতে ১০০জনে ১ জন মারা যায়, আর ভ্যাক্সিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় যদি ১০০ জনে ২ জন মারা যায়, তাহলে কিন্তু ভ্যাক্সিনটি কার্যকর হবেনা। আর এই কারণেই বাজারে ছাড়ার আগে ভ্যাক্সিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করতে হয়, প্রথমে গবেষণাগারের প্রাণীদের উপরে, তারপরে পরীক্ষামূলক ভাবে ছোট পরিসরে মানবদেহে। আর এতেই লেগে যায় বছর খানেক সময়। তবে আজ আমরা ভ্যাক্সিন হাতে পাওয়ার একেবারে দ্বারপ্রান্তে। বায়োএনটেক-ফাইজার-এর নিরলস প্রচেষ্টায় খুব দ্রুতই হাতে পেতে যাচ্ছি আমরা বহুপ্রতীক্ষিত করোনার ভ্যাক্সিন। এই ভ্যাক্সিন কিন্তু সাধারন ভ্যাক্সিন থেকে কিছুটা আলাদা। সাধারনত একটা ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে, বা তার ভিতরের আরএনএ-এর উপরে ভিত্তি করে তৈরী হয় ভাইরাস ইন-অ্যাক্টিভেটেড ভ্যাক্সিন। করোনার ভ্যাক্সিন হবে এম-আরএনএ বা ম্যাসেঞ্জার-আরএনএ ভ্যাক্সিন। এই এম-আরএনএ হল প্রোটিন তৈরির নির্দেশিকা। দেহের কোষে এমআরএনএ প্রবেশ করলে, রাইবোজোম নামক কোষের অংশ এই এম-আরএনএ-এর নির্দেশিকা বুঝতে পারে, তৈরি করতে পারে উপযুক্ত প্রোটিন।

এম-আরএনএ-এর এই বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগাতে গবেষকরা তাই মনোনিবেশ করেছেন করোনার স্পাইক প্রোটিনে, যার মাধ্যমে করোনা ভাইরাস মানবদেহে সংযুক্ত হয়। এই স্পাইক প্রোটিনের জেনেটিক সিকুয়েন্সিং করে তারা তৈরি করেছেন এই করোনার স্পাইক প্রোটিন তৈরির নির্দেশ সম্বলিত এম-আরএনএ। এই এম-আরএনএ-কে লিপিড ন্যানোপার্টিকেলের আবরণে সুরক্ষিত করে তারা তৈরি করে ফেলেছেন করোনার ভ্যাক্সিন। শরীরে প্রবেশ করে এই ভ্যাক্সিন আমাদের দেহের কোষের রাইবোজোমকে করোনার স্পাইক প্রোটিন তৈরির নির্দেশ দিবে। এই স্পাইক প্রোটিন ভাইরাসের মূল আরএনএ ছাড়া দেহে কোন অসুখ সৃষ্টি না করলেও, দেহ এই স্পাইক প্রোটিন ধ্বংস করতে অ্যান্টিবডি তৈরি করা শুরু করবে। এইভাবে ২ ডোজে শরীরকে প্রস্তুত করে ফেলা হবে করোনার বিরুদ্ধে। শতকরা ৯০ ভাগ কার্যকর এই ভ্যাক্সিন হাতে এলে আমাদের জীবন অনেকটাই ফিরে পাবে তার স্বাভাবিকতা। তবে এখানেও আছে কিছু খটকা। ভাইরাসের বহিঃপৃষ্ঠের স্পাইক প্রোটিন ভিতরের আরএনএ-এর চাইতে অনেক দ্রুত মিউটেটেড হয়। আর তাই উদ্ভাবিত ভ্যাক্সিন যে স্পাইক প্রোটিন-কে ব্যবহার করে তৈরি, করোনার স্পাইক প্রোটিন তার থেকে খুব বেশি পরিবর্তিত হয়ে গেলে কিন্তু এই ভ্যাক্সিন আর কাজ করবেনা। এম-আরএনএ ভ্যাক্সিনের আরো একটা সমস্যা হল, এই ভ্যাক্সিন -৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষন করতে হয়। আমাদের বাসার বা সাধারণ ঔষধের দোকানের ডিপ ফ্রিজ কিন্তু মাত্র -২০ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই ফ্রিজে ভ্যাক্সিন রাখা যাবে সর্বোচ্চ ৫ দিন। আর তাই ভ্যাক্সিন বাজারে আসলেও, সাধারণ ঔষধের মত তা সব দোকানে পাওয়া যাবেনা। শুধুমাত্র বড় হাসপাতালগুলোতে এই ভ্যাক্সিনের দেখা মিলবে। -৭৮ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ড্রাই আইস হয়তো এক্ষেত্রে সাময়িকভাবে কাজে আসতে পারে, কিন্তু এতে বেড়ে যাবে বহন খরচ। দেশের প্রত্যন্ত, এমনকি মফঃস্বল অঞ্চলেও এই ভ্যাক্সিনের বিতরণ তাই হয়ে উঠতে পারে ভাবনার বিষয়।

কিন্তু ভ্যাক্সিন আসলেই কি আমরা নিরাপদে আগের মত বাঁচতে পারব ? ২০০৩ এর সার্সে আক্রান্ত ১০০ জনে মারা গেছেন গড়ে ১০ জন, মধ্যপ্রাচ্যের সার্সে মারা গেছেন ১০০ জনে গড়ে ৩৯ জন; অথচ সার্স-কোভ-২ এ ১০০ জনে মৃত্যুর হার গড়ে মাত্র ১জন। তবে কেন আগের দুটো ঘটনা মহামারী অথচ আজকের করোনা ভাইরাস অতিমারী ? এর কারণ সংক্রমণ। যেখানে সার্স-এ সর্বমোট আক্রান্ত হয়েছিল ৮হাজার জন মানুষ। আর সার্স-কোভ-২, ২০২১ এর জানুয়ারী পর্যন্ত আক্রান্ত করেছে অন্তত সাড়ে ৮ কোটি কিন্তু ভ্যাক্সিন আসলেই কি আমরা নিরাপদে আগের মত বাঁচতে পারব ? ২০০৩ এর সার্সে আক্রান্ত ১০০ জনে মারা গেছেন গড়ে ১০ জন, মধ্যপ্রাচ্যের সার্সে মারা গেছেন ১০০ জনে গড়ে ৩৯ জন; অথচ সার্স-কোভ-২ এ ১০০ জনে মৃত্যুর হার গড়ে মাত্র ১জন। তবে কেন আগের দুটো ঘটনা মহামারী অথচ আজকের করোনা ভাইরাস অতিমারী ? এর কারণ সংক্রমণ। যেখানে সার্স-এ সর্বমোট আক্রান্ত হয়েছিল ৮হাজার জন মানুষ। আর সার্স-কোভ-২, ২০২১ এর জানুয়ারী পর্যন্ত আক্রান্ত করেছে অন্তত সাড়ে ৮ কোটি মানুষকে, নিয়ে নিয়েছে সাড়ে ১৮লক্ষ মানুষের প্রাণ। সার্স-কোভ২ এর মৃত্যুহার কম হলেও এর অভাবনীয় সংক্রমণ ক্ষমতা তাই একে করে তুলেছে ভয়ংকর। আগের মহামারীগুলো তাই রুখে গিয়েছিল সংক্রমণ প্রতিরোধ আর সচেতনতার জোরে কিন্তু সার্স-কোভ-২ ইতিমধ্যে ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। ভ্যাক্সিন আসলেও তা সহজলভ্য হতে সময় লাগবে। সবাই এই ভ্যাক্সিন নিয়ে নিলেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই করোনা নিজেকে পরিবর্তন করতেই থাকবে, মানব দেহে না পারলে পশু-পাখির দেহে। আমরা ততদিন-ই সুরক্ষিত থাকব যতদিন এই পরিবর্তন ভ্যাক্সিনের আওতায় থাকে। আর তাই করোনাভাইরাস আমাদের আঘাত হানবে বারবার। কোভিড-১৯ এর প্রথম সংক্রমণের পর ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় সংক্রমণও শুরু হয়ে গেছে সারা বিশ্বে। যাকে বলা হচ্ছে ’সেকেন্ড ওয়েভ’। আর তাই সুরক্ষিত থাকতে হলে শুধু ভ্যাক্সিন নয়, আমাদের নিজেদের তৈরি করতে হবে। সার্স-কোভ-২ আমাদের দেহে প্রধানত প্রবেশ করে মুখ, নাক বা চোখ দিয়ে, আর তাই আমাদের মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, অন্তত যতদিন কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ না কমে, ততদিন। আমাদের বিশেষ নজর রাখতে হবে আমাদের হাতের দিকে, জনবহুল পরিস্থিতিতে ¯পর্শ যতসম্ভব সীমিত করতে হবে আর হাত পরিষ্কার না করে কোনভাবেই মুখে হাত দেওয়া যাবেনা। সার্স-কোভ-২ এর লিপিডের আবরণ সহজেই ভেঙ্গে যায় সাবান বা ৭০% অ্যালকোহলের স্পর্শে। ঘন ঘন হাত ধুলেই তাই আমরা থাকতে পারব অনেকখানি নিরাপদ। ব্যক্তিউদ্যোগ বাদে, গবেষণাগারগুলোকে ভবিষ্যতের সকল মিউটেশন বা পরিবর্তনের জন্য থাকতে হবে প্রস্তুত, যাতে ভবিষ্যত অতিমারী জেগে উঠার আগেই নিভিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু এতে দরকার অনেক অনেক অর্থায়ন, আর ভবিষ্যতের সব করোনার স্ট্রেইন এইভাবে ছড়িয়েও পরবে না, অথচ সুরক্ষিত থাকতে ভ্যাক্সিন তৈরি রাখতে হবে অনাগত সব স্ট্রেইনের। ঔষধ কোম্পানিগুলোর জন্য এক্ষেত্রে ভবিষ্যতের সব ধরনের ভ্যাক্সিন তৈরি সম্ভব নয়, কারন ভ্যাক্সিন তৈরি ব্যয়বহুল, আর উদ্ভাবিত ভ্যাক্সিন কাজে না আসলে তা ব্যবসায়ে লোকসান বাদে কিছু নয়। তাই ব্যবসায়ীক নয়, প্রতিরক্ষামূলক গবেষণায় এখন আমাদের অর্থায়ন করতে হবে আর প্রস্তুত থাকতে হবে আগামীর জন্য। তবে সে প্রস্তুতির বাস্তবায়ন নির্ভর করবে আমাদের নীতিনির্ধারকদের বোধদয়ের উপর। জীবনযাত্রার স্বাভাবিকতা হয়তো কোনদিন ফিরবে, কিন্তু সেই স্বাভাবিক ২০১৯ এর ডিসেম্বরের আগের স্বাভাবিক থেকে হবে আলাদা। পকেটে হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর মুখে মাস্ক দিয়েই আমাদের বরণ করে নিতে হবে নতুন স্বাভাবিককে। মানব ইতিহাসে করোনা যুগের প্রবর্তন খুব সম্ভব হয়ে গিয়েছে, এ যুগের সমাপ্তি এখন প্রকৃতির হাতে।

ড. মোঃ ফাইয়াদ হাসান
পোস্ট-ডক্টোরাল রিসার্চ ফেলো
মায়ো ক্লিনিক, রচেস্টার, মিনেসোটা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

Reference:
1. Center for disease control and prevention (CDC.gov)
2. Jeffrey S. Kahn and, Kenneth McIntosh, “History and Recent Advances in Coronavirus Discovery”, 2005,
The Pediatric Infectious Disease Journal, 24(11), S223-S227
doi: 10.1097/01.inf.0000188166.17324.60
3. Yen-Chin Liu, Rei-Lin Kuo, Shin-Ru Shih, “COVID-19: The first documented coronavirus pandemic in
history”,2020, Biomedical Journal, 43(4), 328-333.
doi:10.1016/j.bj.2020.04.007.
4. Anthony R Fehr, and Stanley Perlman. “Coronaviruses: an overview of their replication and
pathogenesis.” 2015, Methods in molecular biology, 1282 (2015): 1-23.
doi:10.1007/978-1-4939-2438-7_1
5. BBC News: “Coronavirus vaccine: When will we have one?” by James Gallagher
6. Lisa A. Jackson, et al. “An mRNA Vaccine against SARS-CoV-2 — Preliminary Report”,2020, The New
England Journal of Medicine, 383(20), 1920-1931
doi:10.1056/NEJMoa2022483
7. NBC News.

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

করোনা যুগের প্রবর্তন

আপডেট সময় ০৯:৩০:০৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হয়তো এই প্রথম করোনা অতিমারী প্রথম একটা বৈশ্বিক ঘটনা যা সমগ্র পৃথিবীর সবগুলো দেশের জীবনযাত্রা একসাথে থমকে দিয়েছে। খোলা মাঠের ঘাসে গড়াগড়ি দিয়ে বেড়ে উঠা প্রজন্মের উত্তরসুরিরা এখন খুব সম্ভবত বেড়ে উঠবে মাস্ক অথবা ঘরের খাঁচায়। অথচ এই করোনা ভাইরাস কিন্তু নতুন কিছু নয়, আমরা অনেক আগে থেকেই জেনে-না জেনে এই ভাইরাসটির সাথে বসবাস করছি। হালকা সর্দি কাশি আমাদের সবার-ই কমবেশি হয়, এই হালকা ঠান্ডা লাগাতেও করোনা হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ নয়। গড়ে ১৫% হালকা সর্দি কাশির কারণ করোনা প্রজাতির ভাইরাস। তাহলে কিভাবে এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠল এই চেনা ভাইরাস ? আমরা কি আসলেই পারব একে ঠেকাতে ? নাকি নিজেদের অভিযোজিত করতে হবে করোনার সাথে?

১৯৬৫ সাল। ভাইরোলজির স্বর্ণযুগ। গবেষকরা মাত্র গবেষণাগারে ভাইরাস কালচার করা আরম্ভ করেছেন। বিভিন্ন ভাইরাস কিভাবে বৃদ্ধি পায়, কোন ঔষধ কোন ভাইরাসের উপরে কাজ করে তা পরীক্ষা করে দেখছেন। টাইরেল আর বাইনো নামের দুইজন গবেষক এই সময়ে আবিষ্কার করলেন বি ৮১৪ ভাইরাস। এই ভাইরাস এতটাই নিরীহ ছিল যে, তারা এই ভাইরাসটি মানুষের নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে দেখলেন যে তা সামান্য সর্দি কাশি ছাড়া আর কিছুর উদ্রেগ করে না। এই সময়ে খুব বেশী কিছু জানা যায়নি এই ভাইরাসগুলো নিয়ে। ১৯৬৮ সালে টাইরেল এবং আমেডিয়া প্রথম ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে ভাইরাসগুলো দেখেন এবং জানান যে এগুলো দেখতে রশ্মি বিকীর্ণ সূর্যের মত, যা দেখতে মুকুট সদৃশ। ‘করোনা’ একটি ল্যাটিন শব্দ, যার অর্থ ‘মুকুট’। তাই, এই মুকুটের মত দেখতে ভাইরাসের অবয়ব থেকেই এই ভাইরাসগুলোর নামকরণ করা হয় করোনা ভাইরাস। অসুখের তীব্রতা কম হওয়ায় এরা তখনও আলোচনায় আসেনি।

গবেষকরা যখন মানবদেহের করোনা ভাইরাস মোকাবিলা নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন, করোনা ভাইরাস তখন অবাধে নিজেকে
অভিযোজিত করে নিচ্ছিলো পশুপাখির মাধ্যমে। ইঁদুর, মুরগী, কুকুর, বিড়াল, বাদুর, খরগোস ইত্যাদি প্রানীদের মাঝে পাওয়া যাচ্ছিল করোনার নতুন নতুন স্ট্রেইন।

পশুপাখি থেকে মানুষে ভাইরাসের সংক্রমণ তখনও চিন্তার কারণ হয়নি। এই সুযোগে দু-দিনে সেরে যাওয়া অসুখের তালিকার এই করোনা হঠাৎ করেই শিরোনামে চলে আসে ২০০৩ সালে। ‘সিভিয়ার অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিন্ড্রোম’ বা ‘সার্স’-এর মাধ্যমে। দক্ষিন চায়নায় এটি প্রথম খুঁজে পাওয়া যায়। তবে পশুপাখি থেকেই সার্স-এর উৎপত্তি কিনা তা জানতে বন্য পশু ব্যবসায়ীদের পরীক্ষা করে দেখা যায় তাদের ৪০% সার্স পজিটিভ। উপসর্গ ছাড়াই যে এই করোনা ভাইরাস পশুপাখী থেকে মানব দেহে এসে ওত পেতে বসে থাকে, তা এই সময়ে পরিষ্কার হয়ে উঠে। জিনোম গবেষণা ও সংক্রমণের কঠোর প্রতিরোধে, ২৯ দেশে ছড়িয়ে পড়া এই সার্স ৭৭৪ জন মানুষের প্রাণ নিয়ে বিদায় নেয় ২০০৪ সালে আর আমাদের জন্য রেখে যায় হুঁশিয়ারবানী। এরপরে ২০১২ সাল পর্যন্ত দুইটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে করোনা ভাইরাসের নতুন সংক্রমণ পাওয়া যায়নি। ২০১২ সালে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে করোনা ভাইরাস। এবার, মধ্যপ্রাচ্যে, এম ই আর এস – সি ও ভি নামে। সার্সের চাইতেও ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পরে এই ভাইরাস সৌদি আরবে, নিয়ে যায় ৪৯৫ জন মানুষের প্রাণ।

খটমটে বিজ্ঞানের ভাষায় চিন্তা না করে ঘটনাগুলো দেখে কিন্তু এমনটাই মনে হয় যে এই করোনা অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছে মানবজাতিকে ভয়াবহ ভাবে আক্রমন করতে। নিরীহ ভাবে জন্ম নিলেও, সে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিল পারিপার্শ্বিকতার সাথে। সাবধান হওয়ার সুযোগ না দিয়ে, মানব দেহে সামান্য ঠান্ডার বেশে ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছিল পশুপাখির দেহে। শুধুমাত্র বাদুরের দেহেই তাই এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে অন্তত ৫০ ধরনের করোনা ভাইরাস। একটা ভাইরাস যখন মানব দেহে জন্ম নেয় তখন সে তার নিজের স্বার্থেই মানিয়ে নেয় মানুষের সাথে। এই ধরনের ভাইরাসের মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত সক্ষমতা কিছুটা হলেও আমাদের আছে। কিন্তু যখন অন্য প্রাণীর দেহে জন্ম নেওয়া ভাইরাস মানবদেহে ঝাঁপিয়ে পরে, তখন দেখা যায় বিপত্তি। আর এই করোনা ভাইরাস ছিল ঠিক তাই। ধারনা করা হয় এই বাদুর-ই এই ভাইরাসের প্রধান আশ্রয়স্থল। আর এই বাদুর থেকেই আরেকবারের মত মাথাচাড়া দিয়ে উঠে করোনা ভাইরাস ২০১৯ এর ডিসেম্বরে, চায়নার উহানে।

চায়নার উহান শহর বিখ্যাত তার কাঁচা মাংসের বাজারের জন্য। বাংলাদেশের প্রচলিত পশুপাখি ছাড়াও আরো নানা রকমের পশুপাখির হাটবাজার বসে উহানে। যদিও বাদুরের মাংস সে সময় নিষিদ্ধ ছিল উহানে। খুব সম্ভবত চায়নার বিভিন্ন দুর্গম গুহার কোন এক বাদুরের দেহে বেড়ে উঠা এক করোনা ভাইরাসের স্ট্রেইন ছড়িয়ে পরে কোন এক পশুর মাঝে। আর সেই পশুর মাংস থেকে তা চলে আসে মানবদেহে। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে তা আলোকগতিতে ছড়িয়ে পরে হাজার হাজার মানুষে। চায়না সরকারের টনক নড়ার আগেই তা মহামারীতে পরিণত হয়। নিজেদের দোষ ঢাকতে ব্যস্ত চায়না সরকারের গড়িমসিতে তা ছড়িয়ে পরে পৃথিবীর প্রায় সব-কটা দেশে। এই ভাইরাসের নামকরণ করা হয় সার্স-কোভ-২, আর এই ভাইরাসের সংক্রমণে সৃষ্ট অসুখের নাম দেওয়া হয় কোভিড-১৯। এর পরের বাকিটা সবাই আমরা কম বেশি জানি। তবে এখানে প্রশ্ন হল, ১৯৬৫ সালে আবিষ্কৃত এই ভাইরাস, যা কিনা গত ১৬ বছরে দুইবার হানা দিল, তার প্রতিরোধে এত সময় কেন লাগছে?

সার্স-কোভ-২ একধরনের আর এন এ ভাইরাস। এই ভাইরাসগুলো আসলে সহজ ভাষায় তেল জাতীয় লিপিডের আবরণে প্রোটিনের একটি সুতো। এই ভাইরাসের দেহ থেকে মুকুটের মতন স্পাইক ছড়িয়ে থাকে। এই স্পাইকগুলো মানবদেহের এসিই-২ এনজাইমের সাথে আটকে যায়। সার্স-কোভ-২ আরো ভয়ংকর কারণ সে নিজেকে বিবর্তিত করে নিয়েছে তার স্পাইক প্রোটিনকে পরিবর্তিত করে। সব করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন কিন্তু মানবদেহে আটকে যেতে পারেনা, কোভ-২ তার স্পাইক প্রোটিন-কে পরিবর্তিত করেছে মানবদেহে অতি-সহজে প্রবেশ করতে। শরীরে প্রবেশ করেই এই ভাইরাসের কাজ হল নিজের এই এন প্রোটিন সুতোটা বা আরএনএ কে মানব দেহের কোষের উপাদান ব্যবহার করে কপি করা ও তাকে লিপিডে আবৃত করে নিজের মতন অসংখ্য ভাইরাস তৈরি করা। এভাবেই দেহে ছড়িয়ে পরে সার্স-কোভ-২। তবে এই ধরনের ভাইরাসের আরএনএ অনুকরনের প্রক্রিয়াটি একেবারে নিখুঁত নয়। এই অনুকরনে প্রায়শঃ ভুল করে বসে তারা। আর এর জন্যই এক দেহ থেকে আরেক দেহে সংক্রমণের মাঝেই পাল্টে যেতে পারে ভাইরাস। এই পালটে যাওয়াটাকে বলে মিউটেশন। এই মিউটেশন সবসময় যে খারাপ তা নয়, অনেক সময় মিউটেশনের মাধ্যমে ভাইরাস তার প্রকোপ হারিয়ে বসে। তবে সমস্যা হল এই মিউটেশন খুব বেশী হলে এক মিউটেশনের ভ্যাক্সিন বদলে যাওয়া ভাইরাসকে রুখতে পারবেনা।

এই ভ্যাক্সিন তৈরির প্রক্রিয়াটি কিন্তু মজার। ভাইরাসের থাকে অ্যান্টিজেন, সেই অ্যান্টিজেনকে চিনতে পারে নির্দিষ্ট কিছু অ্যান্টিবডি। কোন একটা ভাইরাস যদি আমাদের দেহের আগে থেকে চেনা থাকে, তাহলে সেই ভাইরাসকে চিনতে পারা অ্যান্টিবডি আমাদের দেহে প্রস্তুত থাকে। আর তাই সেই চেনা ভাইরাস দেহে প্রবেশ করা মাত্র অ্যান্টিবডি ঝাঁপিয়ে পরে ভাইরাসগুলোকে মেরে ফেলে। কিন্তু অচেনা কোন ভাইরাস আমাদের দেহে প্রবেশ করলে আমাদের দেহ তখন বেকায়দায় পরে যায়, কারণ উপযুক্ত অ্যান্টিবডি তৈরি থাকেনা। এই সুযোগে ভাইরাস ছড়িয়ে পরে সারা দেহে।

ভ্যাক্সিন আসলে এই ভাইরাসের নিরাপদ সংস্করন অথবা ভাইরাসের একটি অংশ যাতে অ্যান্টিজেন থাকে কিন্তু রোগ সৃষ্টিকারী অংশটুকু থাকেনা। এই নিরাপদ অ্যান্টিজেন দেহে নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রবেশ করলে আমাদের শরীরে তখন উপযুক্ত অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, ফলে পরবর্তীতে আসল ভাইরাসের জন্য তৈরি থাকে আমাদের দেহ। কিন্তু শরীরের এই অ্যান্টিবডি তৈরি বা ইমিউন রেস্পন্সের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে।

ধরুন একটা রোগ যাতে ১০০জনে ১ জন মারা যায়, আর ভ্যাক্সিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় যদি ১০০ জনে ২ জন মারা যায়, তাহলে কিন্তু ভ্যাক্সিনটি কার্যকর হবেনা। আর এই কারণেই বাজারে ছাড়ার আগে ভ্যাক্সিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করতে হয়, প্রথমে গবেষণাগারের প্রাণীদের উপরে, তারপরে পরীক্ষামূলক ভাবে ছোট পরিসরে মানবদেহে। আর এতেই লেগে যায় বছর খানেক সময়। তবে আজ আমরা ভ্যাক্সিন হাতে পাওয়ার একেবারে দ্বারপ্রান্তে। বায়োএনটেক-ফাইজার-এর নিরলস প্রচেষ্টায় খুব দ্রুতই হাতে পেতে যাচ্ছি আমরা বহুপ্রতীক্ষিত করোনার ভ্যাক্সিন। এই ভ্যাক্সিন কিন্তু সাধারন ভ্যাক্সিন থেকে কিছুটা আলাদা। সাধারনত একটা ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে, বা তার ভিতরের আরএনএ-এর উপরে ভিত্তি করে তৈরী হয় ভাইরাস ইন-অ্যাক্টিভেটেড ভ্যাক্সিন। করোনার ভ্যাক্সিন হবে এম-আরএনএ বা ম্যাসেঞ্জার-আরএনএ ভ্যাক্সিন। এই এম-আরএনএ হল প্রোটিন তৈরির নির্দেশিকা। দেহের কোষে এমআরএনএ প্রবেশ করলে, রাইবোজোম নামক কোষের অংশ এই এম-আরএনএ-এর নির্দেশিকা বুঝতে পারে, তৈরি করতে পারে উপযুক্ত প্রোটিন।

এম-আরএনএ-এর এই বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগাতে গবেষকরা তাই মনোনিবেশ করেছেন করোনার স্পাইক প্রোটিনে, যার মাধ্যমে করোনা ভাইরাস মানবদেহে সংযুক্ত হয়। এই স্পাইক প্রোটিনের জেনেটিক সিকুয়েন্সিং করে তারা তৈরি করেছেন এই করোনার স্পাইক প্রোটিন তৈরির নির্দেশ সম্বলিত এম-আরএনএ। এই এম-আরএনএ-কে লিপিড ন্যানোপার্টিকেলের আবরণে সুরক্ষিত করে তারা তৈরি করে ফেলেছেন করোনার ভ্যাক্সিন। শরীরে প্রবেশ করে এই ভ্যাক্সিন আমাদের দেহের কোষের রাইবোজোমকে করোনার স্পাইক প্রোটিন তৈরির নির্দেশ দিবে। এই স্পাইক প্রোটিন ভাইরাসের মূল আরএনএ ছাড়া দেহে কোন অসুখ সৃষ্টি না করলেও, দেহ এই স্পাইক প্রোটিন ধ্বংস করতে অ্যান্টিবডি তৈরি করা শুরু করবে। এইভাবে ২ ডোজে শরীরকে প্রস্তুত করে ফেলা হবে করোনার বিরুদ্ধে। শতকরা ৯০ ভাগ কার্যকর এই ভ্যাক্সিন হাতে এলে আমাদের জীবন অনেকটাই ফিরে পাবে তার স্বাভাবিকতা। তবে এখানেও আছে কিছু খটকা। ভাইরাসের বহিঃপৃষ্ঠের স্পাইক প্রোটিন ভিতরের আরএনএ-এর চাইতে অনেক দ্রুত মিউটেটেড হয়। আর তাই উদ্ভাবিত ভ্যাক্সিন যে স্পাইক প্রোটিন-কে ব্যবহার করে তৈরি, করোনার স্পাইক প্রোটিন তার থেকে খুব বেশি পরিবর্তিত হয়ে গেলে কিন্তু এই ভ্যাক্সিন আর কাজ করবেনা। এম-আরএনএ ভ্যাক্সিনের আরো একটা সমস্যা হল, এই ভ্যাক্সিন -৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষন করতে হয়। আমাদের বাসার বা সাধারণ ঔষধের দোকানের ডিপ ফ্রিজ কিন্তু মাত্র -২০ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই ফ্রিজে ভ্যাক্সিন রাখা যাবে সর্বোচ্চ ৫ দিন। আর তাই ভ্যাক্সিন বাজারে আসলেও, সাধারণ ঔষধের মত তা সব দোকানে পাওয়া যাবেনা। শুধুমাত্র বড় হাসপাতালগুলোতে এই ভ্যাক্সিনের দেখা মিলবে। -৭৮ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ড্রাই আইস হয়তো এক্ষেত্রে সাময়িকভাবে কাজে আসতে পারে, কিন্তু এতে বেড়ে যাবে বহন খরচ। দেশের প্রত্যন্ত, এমনকি মফঃস্বল অঞ্চলেও এই ভ্যাক্সিনের বিতরণ তাই হয়ে উঠতে পারে ভাবনার বিষয়।

কিন্তু ভ্যাক্সিন আসলেই কি আমরা নিরাপদে আগের মত বাঁচতে পারব ? ২০০৩ এর সার্সে আক্রান্ত ১০০ জনে মারা গেছেন গড়ে ১০ জন, মধ্যপ্রাচ্যের সার্সে মারা গেছেন ১০০ জনে গড়ে ৩৯ জন; অথচ সার্স-কোভ-২ এ ১০০ জনে মৃত্যুর হার গড়ে মাত্র ১জন। তবে কেন আগের দুটো ঘটনা মহামারী অথচ আজকের করোনা ভাইরাস অতিমারী ? এর কারণ সংক্রমণ। যেখানে সার্স-এ সর্বমোট আক্রান্ত হয়েছিল ৮হাজার জন মানুষ। আর সার্স-কোভ-২, ২০২১ এর জানুয়ারী পর্যন্ত আক্রান্ত করেছে অন্তত সাড়ে ৮ কোটি কিন্তু ভ্যাক্সিন আসলেই কি আমরা নিরাপদে আগের মত বাঁচতে পারব ? ২০০৩ এর সার্সে আক্রান্ত ১০০ জনে মারা গেছেন গড়ে ১০ জন, মধ্যপ্রাচ্যের সার্সে মারা গেছেন ১০০ জনে গড়ে ৩৯ জন; অথচ সার্স-কোভ-২ এ ১০০ জনে মৃত্যুর হার গড়ে মাত্র ১জন। তবে কেন আগের দুটো ঘটনা মহামারী অথচ আজকের করোনা ভাইরাস অতিমারী ? এর কারণ সংক্রমণ। যেখানে সার্স-এ সর্বমোট আক্রান্ত হয়েছিল ৮হাজার জন মানুষ। আর সার্স-কোভ-২, ২০২১ এর জানুয়ারী পর্যন্ত আক্রান্ত করেছে অন্তত সাড়ে ৮ কোটি মানুষকে, নিয়ে নিয়েছে সাড়ে ১৮লক্ষ মানুষের প্রাণ। সার্স-কোভ২ এর মৃত্যুহার কম হলেও এর অভাবনীয় সংক্রমণ ক্ষমতা তাই একে করে তুলেছে ভয়ংকর। আগের মহামারীগুলো তাই রুখে গিয়েছিল সংক্রমণ প্রতিরোধ আর সচেতনতার জোরে কিন্তু সার্স-কোভ-২ ইতিমধ্যে ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। ভ্যাক্সিন আসলেও তা সহজলভ্য হতে সময় লাগবে। সবাই এই ভ্যাক্সিন নিয়ে নিলেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই করোনা নিজেকে পরিবর্তন করতেই থাকবে, মানব দেহে না পারলে পশু-পাখির দেহে। আমরা ততদিন-ই সুরক্ষিত থাকব যতদিন এই পরিবর্তন ভ্যাক্সিনের আওতায় থাকে। আর তাই করোনাভাইরাস আমাদের আঘাত হানবে বারবার। কোভিড-১৯ এর প্রথম সংক্রমণের পর ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় সংক্রমণও শুরু হয়ে গেছে সারা বিশ্বে। যাকে বলা হচ্ছে ’সেকেন্ড ওয়েভ’। আর তাই সুরক্ষিত থাকতে হলে শুধু ভ্যাক্সিন নয়, আমাদের নিজেদের তৈরি করতে হবে। সার্স-কোভ-২ আমাদের দেহে প্রধানত প্রবেশ করে মুখ, নাক বা চোখ দিয়ে, আর তাই আমাদের মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, অন্তত যতদিন কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ না কমে, ততদিন। আমাদের বিশেষ নজর রাখতে হবে আমাদের হাতের দিকে, জনবহুল পরিস্থিতিতে ¯পর্শ যতসম্ভব সীমিত করতে হবে আর হাত পরিষ্কার না করে কোনভাবেই মুখে হাত দেওয়া যাবেনা। সার্স-কোভ-২ এর লিপিডের আবরণ সহজেই ভেঙ্গে যায় সাবান বা ৭০% অ্যালকোহলের স্পর্শে। ঘন ঘন হাত ধুলেই তাই আমরা থাকতে পারব অনেকখানি নিরাপদ। ব্যক্তিউদ্যোগ বাদে, গবেষণাগারগুলোকে ভবিষ্যতের সকল মিউটেশন বা পরিবর্তনের জন্য থাকতে হবে প্রস্তুত, যাতে ভবিষ্যত অতিমারী জেগে উঠার আগেই নিভিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু এতে দরকার অনেক অনেক অর্থায়ন, আর ভবিষ্যতের সব করোনার স্ট্রেইন এইভাবে ছড়িয়েও পরবে না, অথচ সুরক্ষিত থাকতে ভ্যাক্সিন তৈরি রাখতে হবে অনাগত সব স্ট্রেইনের। ঔষধ কোম্পানিগুলোর জন্য এক্ষেত্রে ভবিষ্যতের সব ধরনের ভ্যাক্সিন তৈরি সম্ভব নয়, কারন ভ্যাক্সিন তৈরি ব্যয়বহুল, আর উদ্ভাবিত ভ্যাক্সিন কাজে না আসলে তা ব্যবসায়ে লোকসান বাদে কিছু নয়। তাই ব্যবসায়ীক নয়, প্রতিরক্ষামূলক গবেষণায় এখন আমাদের অর্থায়ন করতে হবে আর প্রস্তুত থাকতে হবে আগামীর জন্য। তবে সে প্রস্তুতির বাস্তবায়ন নির্ভর করবে আমাদের নীতিনির্ধারকদের বোধদয়ের উপর। জীবনযাত্রার স্বাভাবিকতা হয়তো কোনদিন ফিরবে, কিন্তু সেই স্বাভাবিক ২০১৯ এর ডিসেম্বরের আগের স্বাভাবিক থেকে হবে আলাদা। পকেটে হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর মুখে মাস্ক দিয়েই আমাদের বরণ করে নিতে হবে নতুন স্বাভাবিককে। মানব ইতিহাসে করোনা যুগের প্রবর্তন খুব সম্ভব হয়ে গিয়েছে, এ যুগের সমাপ্তি এখন প্রকৃতির হাতে।

ড. মোঃ ফাইয়াদ হাসান
পোস্ট-ডক্টোরাল রিসার্চ ফেলো
মায়ো ক্লিনিক, রচেস্টার, মিনেসোটা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

Reference:
1. Center for disease control and prevention (CDC.gov)
2. Jeffrey S. Kahn and, Kenneth McIntosh, “History and Recent Advances in Coronavirus Discovery”, 2005,
The Pediatric Infectious Disease Journal, 24(11), S223-S227
doi: 10.1097/01.inf.0000188166.17324.60
3. Yen-Chin Liu, Rei-Lin Kuo, Shin-Ru Shih, “COVID-19: The first documented coronavirus pandemic in
history”,2020, Biomedical Journal, 43(4), 328-333.
doi:10.1016/j.bj.2020.04.007.
4. Anthony R Fehr, and Stanley Perlman. “Coronaviruses: an overview of their replication and
pathogenesis.” 2015, Methods in molecular biology, 1282 (2015): 1-23.
doi:10.1007/978-1-4939-2438-7_1
5. BBC News: “Coronavirus vaccine: When will we have one?” by James Gallagher
6. Lisa A. Jackson, et al. “An mRNA Vaccine against SARS-CoV-2 — Preliminary Report”,2020, The New
England Journal of Medicine, 383(20), 1920-1931
doi:10.1056/NEJMoa2022483
7. NBC News.